নতুন শিক্ষাক্রম: একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে হবে আলাদা দুইটা বোর্ড পরীক্ষা
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ দীর্ঘ ৬৫ বছর পর চলতি শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সবাই পড়ছে একই বিষয়। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী চালু হয়েছে এ প্রক্রিয়া। যেখানে নেই বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য শাখার বিভাজন। সবার বই এক, ক্লাসরুম এক, মূল্যায়ন পদ্ধতিও এক। তবে বেশিরভাগ অভিভাবক বিষয়টি ভালোভাবে নিচ্ছেন না। তারা বিভাগ বিভাজনের পক্ষে মত দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ একমুখী এ পদ্ধতিকে ভালো বলছেন। এমন মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও প্রায় সব অভিভাবকের প্রশ্ন, নতুন শিক্ষাক্রমে বিভাগ বিভাজন কখন থেকে এবং কীভাবে?
অভিভাবকদের এমন প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর নেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কাছেও। এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলেন, নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বিষয়টির ধারণা থাকলেও তা চূড়ান্ত নয়। চলতি বছর যেহেতু একাদশ-দ্বাদশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে না, তাই এ নিয়ে তোড়জোড়ও করছেন না তারা। এ বিষয়ে অনুসন্ধান ও যাচাই প্রক্রিয়ায় ‘ধীরে চলা’র নীতি নিয়েছে এনসিটিবি। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট রূপরেখা দাঁড় করানো হতে পারে।
জানা গেছে, ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়। চলতি বছর আরও চার শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়ানো হচ্ছে। সেগুলো হলো- দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম। আগামী বছর অর্থাৎ, ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর মাধ্যমে মাধ্যমিক পর্যন্ত স্তরে সব শ্রেণিতেই তা চালু হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম।
নতুন শিক্ষাক্রমে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে। আগে এটি নবম-দশম শ্রেণি মিলিয়ে করা হতো। ২০২৬ সালে নতুন শিক্ষাক্রমে শুধু দশম শ্রেণির বই পড়ে শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে।
বিভাগ বিভাজন কখন, কীভাবে?
উচ্চমাধ্যমিক তথা একাদশ শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজনের একটি ধারণা নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় রয়েছে। তবে এর পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি এখনো দাঁড় করানো যায়নি বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা।
তাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা হলো- উচ্চমাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন হবে। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় সবার জন্যই বাধ্যতামূলক থাকবে। নির্বাচিত বিষয়গুলো; যেমন- পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি থেকে একজন শিক্ষার্থী তার আগ্রহ অনুযায়ী যেকোনো তিনটি বিষয় নির্বাচন করতে পারবে।
বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্যের বিভাজন তুলে দেওয়ায় আমাদের শিক্ষা হুমকির মুখে পড়তে পারে। সবাই সব শিখতে গিয়ে দেখা যাবে কেউই কিছুই ঠিকভাবে শিখছে না। আর মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার এ অপূর্ণতার কারণে তারা উচ্চপর্যায়ে আর বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহীই হবে না।
কোনো শিক্ষার্থী চাইলে বিজ্ঞান বিষয়ের পাশাপাশি অন্য বিভাগের বিষয়ও নেওয়ার সুযোগ পাবে। যেমন- একজন শিক্ষার্থী চাইলে পদার্থ, রসায়নের পাশাপাশি অর্থনীতিও নেওয়ার সুযোগ পাবে। একইভাবে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও মিশ্র বিষয় নেওয়ার সুযোগ পাবে। এছাড়া নতুন পদ্ধতিতে পেশাগত দক্ষতার জন্য আরেকটি বিষয় ঐচ্ছিকভাবে নেওয়ার সুযোগ রাখা হতে পারে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির শিক্ষাক্রম ইউনিটের সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কীভাবে বিভাগ বিভাজনের সুযোগ দেওয়া হবে, তা এখনো চূড়ান্ত করিনি আমরা। এ বছরের মাঝামাঝি সময়, হয়তো মে-জুনের দিকে এটা চূড়ান্ত করা যেতে পারে। প্রাথমিক কিছু পরিকল্পনা আছে। সেগুলো আলাপ-আলোচনা করে পরিস্থিতি বিবেচনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিভাগ বিভাজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের ‘ভালোর দিকটি বিবেচনায় রেখে’ করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি (একাদশ শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন) এখনো প্রাথমিক পরিকল্পনার স্তরে রয়েছে। যেভাবে পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে, তাতে সবার জন্যই ভালো হবে।
একাদশ-দ্বাদশে পরীক্ষা যেভাবে
বর্তমানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে একই নামের দুটি করে বই পড়েন শিক্ষার্থীরা। নাম এক থাকলেও এগুলো দুই পত্রে বিভক্ত। যেমন- একাদশে পড়েন বাংলা প্রথমপত্র। দ্বাদশে বাংলা দ্বিতীয়পত্র। দুই বছর একই বিষয়গুলোর দুই পত্র পড়ে চূড়ান্ত পাবলিক পরীক্ষা অর্থাৎ, এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন তারা।
নতুন শিক্ষাক্রমে এ প্রক্রিয়াও থাকছে না। নতুন নিয়মে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রত্যেক বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীন পরীক্ষা হবে। এরপর দুই পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে।
উচ্চমাধ্যমিক অর্থাৎ, একাদশ-দ্বাদশে বইয়ের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসবে। তখন বাংলা, ইংরেজি ও সমন্বিত আরেকটি বিষয় সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক থাকবে। বাকি চারটি (তিনটি নৈর্বাচনিক ও একটি ঐচ্ছিক) শিক্ষার্থীরা পছন্দ অনুযায়ী বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ তিন বছরে এসএসসির চেয়ে এইচএসসিতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী অনেক কম। ২০২০ সালে এসএসসিতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল মোট পরীক্ষার্থীর ৩০ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০২১ সালে ছিল ২৮ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং ২০২২ সালে এ হার ছিল ৩১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২০ সালে এইচএসসিতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিলেন ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশ, ২০২১ সালে ২২ দশমিক ৫০ এবং ২০২২ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্যের বিভাজন তুলে দেওয়ায় আমাদের শিক্ষা হুমকির মুখে পড়তে পারে। সবাই সব শিখতে গিয়ে দেখা যাবে কেউই কিছুই ঠিকভাবে শিখছে না। আর মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার এ অপূর্ণতার কারণে তারা উচ্চপর্যায়ে আর বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহীই হবে না।
বিষয়টি মানতে নারাজ নতুন শিক্ষাক্রম প্রণেতাদের অন্যতম, এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান। তিনি দাবি করেন, নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়ার সুযোগ পাবে। এর অর্থ হলো, শতভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যেই বিজ্ঞানের প্রসারতা বাড়বে।
অধ্যাপক মশিউজ্জামান আরও বলেন, নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন করে আমরা কয়জন বিজ্ঞানী তৈরি করতে পেরেছি? আমি মনে করি, নতুন এ শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কোনোভাবেই কমবে না। বরং আগে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞান নিয়ে যে স্বল্প ধারণা ছিল, তা কাটিয়ে ওঠা যাবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২১/০১/২০২৪