নতুন করদাতার খোঁজে এনবিআর
নিউজ ডেস্ক।।
করোনা মহামারিতে হুট করে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। টিকা পেতে অগ্রিম অর্থের সংস্থানও করতে হচ্ছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন অনেক জরুরি ব্যয়ের বোঝা মাথা পেতে নিতে হয় রাষ্ট্রকে। নিয়মিত কর্মযজ্ঞের চাপ তো রয়েছে। বিশ্ব ব্যবস্থা থেকে নতুন কিছু সংযোজনের চেষ্টাও রয়েছে। এসব নতুনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর পাশাপাশি নাগরিকের জীবনযাত্রা, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভ্রমণ, নিরাপত্তা, উদ্ভাবনসহ সব খাতকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাজাতে চাচ্ছে সরকার। ফলে নতুন ধরনের অবকাঠামো, পরিকাঠামো, পরিচালন পদ্ধতির প্রচলন করতে হচ্ছে। এসব কাজে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে সরকারও নতুন নতুন বিনিয়োগ করছে। ফলে প্রতিবছর উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় অর্থাৎ বাজেট বড় হচ্ছে। এ আয় মেটাতে সরকার তাকিয়ে থাকে জনগণের দিকেই। কেননা সবার দেওয়া করের টাকাতেই চলে সরকার। বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে তাই প্রধান রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে বেশি বেশি রাজস্ব চায় সরকার। রাজস্বের বিপুল এ চাহিদা মেটাতে নতুন করদাতা খুঁজে বের করাকে সমাধান মনে করছে এনবিআর। এ জন্য করযোগ্য আয় থাকার পরও যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর দিচ্ছে না, তাদের করের আওতায় আনার কৌশল নিয়েছে এনবিআর।
এ কাজে এনবিআরের জন্য বড় হতাশার জায়গা হলো টিআইএন নেওয়ার পরও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিশাল অংশের আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়ার প্রবণতা। নাগরিকদের মধ্যে স্বেচ্ছায় নতুন করদাতা হিসেবে তালিকাভুক্তির সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য নয়। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ৪৫ লাখ ব্যক্তির টিআইএন রয়েছে। এর মধ্যে রিটার্ন দাখিল হয় ২০ থেকে ২২ লাখ, যাদের সাত থেকে আট লাখ সরকারি কর্মকর্তা। রিটার্ন দাখিলকারীদের অনেকের কর শূন্য। সামগ্রিকভাবে ১৬ থেকে ১৭ লাখ ব্যক্তি থেকে প্রত্যক্ষ কর পাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর দপ্তর থেকে এক লাখ ৭৬ হাজার কোম্পানি নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ৭৮ হাজার কোম্পানির টিআইএন আছে। আবার টিআইএনধারীদের মধ্যে শুধু এক-তৃতীয়াংশ রিটার্ন দেয়। অথচ আইন অনুযায়ী কোম্পানি নিবন্ধন নিলে টিআইএন নিতে হবে এবং রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকা এ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের জিডিপির আকারের পাশাপাশি গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বেতনভুক্ত কর্মীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। সামগ্রিক বিবেচনায় যত সংখ্যক ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক করদাতা দেশে থাকার কথা, তা নেই। বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। অর্থাৎ মাসিক ২৫ হাজার টাকার বেশি আয় থাকলে সে করের আওতাভুক্ত। এ টাকার বেশি আয় করার লোকের সংখ্যা ২২ লাখের অনেক বেশি বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা। এ জন্য করযোগ্য সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে করের আওতায় আনা এনবিআরের মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় জনসংখ্যার অনুপাতে বেশি মানুষ কর দিচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে কর কাঠামোকে আধুনিক করার মাধ্যমে। এনবিআরও সেই চেষ্টা করছে। এ জন্য অনলাইনে টিআইএন খোলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে অনেক আগে। স্বেচ্ছায় আয়কর রিটার্ন দেওয়ার প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। এক পৃষ্ঠার রিটার্ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে এনবিআর। সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য কার্যক্রম সংস্কারের কাজ চলছে।
প্রতিবছর সরকার আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বাড়াচ্ছে। যদিও লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। তবে এ খাতে রাজস্ব সংগ্রহ আগের তুলনায় বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয়কর ও ভ্রমণ খাত থেকে ৬২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করেছে এনবিআর। পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে আদায় বেড়ে হয়েছে ৭২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআর এ খাত থেকে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাত থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে আয়কর থেকে ১৫ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা আহরণ করেছে এনবিআর। এর আগের অর্থবছরের তুলনায় যা সামান্য বেশি। কর্মকর্তারা আশা করছেন, নভেম্বর শেষে এ খাতে রাজস্ব আহরণ আরও বাড়বে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরন পাল্টাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি থেকে রাজস্ব আহরণ কমছে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ অন্য উৎস থেকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট সংগ্রহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এখনও কর দিচ্ছে না, তাদের করের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক দিন থেকে এনবিআর এ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি। বিভিন্ন পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপ কাজও চালানো হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। আগের অর্থবছরের তুলনায় এর পরিমাণ ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি। উন্নয়ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব আহরণ নিশ্চিত করতে এবং দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর পরামর্শ অর্থনীতিবিদ ও বিশ্নেষকদের। এ জন্য করের আওতা বাড়ানো, কর ও ভ্যাট রিটার্ন পদ্ধতি সম্পূর্ণ অনলাইন করা, রিফান্ড পদ্ধতি সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।
এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, করের আওতা বাড়ানো ও নতুন করদাতা খুঁজে বের করার কাজ চলছে। তবে সেটি কোনোভাবেই নাগরিকদের বিব্রত করে নয়। এনবিআর চায়, নাগরিকরা স্বেচ্ছায় কর দেবেন। নাগরিকদের সেই পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
শিক্ষাবার্তা/এসজেড