ধূসর ক্যাম্পাসে কবে বাজবে প্রাণের সুর
ফিরোজ আলম।।
নেই কোলাহল,নেই প্রাণের মেলা।নেই প্রাণের উচ্ছ্বাস, নেই গানের সুর।নেই নতুন বছরে বর্ষবরণ আমেজ,নেই বনভোজন পরিকল্পনার উত্তাপ, নেই শিক্ষা সফরের আয়োজন,নেই নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানের কত শত নিত্য নতুন ভাবনা আর পরিকল্পনা।
শিক্ষাঙ্গনে সব যেন ধূসর হয়ে গেছে অদৃশ্য ওদের (করোনা) আঘাতে।ওদের নিষ্ঠুরতায় ১৪ মাসের ও বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে প্রাণের প্রিয় শিক্ষাঙ্গন। সুযোগ বুঝে ধূসর শিক্ষাঙ্গন রঙ বদলিয়েছে মনের মতন করে। শিক্ষার্থীদের কোলাহলহীন মলিন ক্যাম্পাস সেজেছে আজ নতুন বৃক্ষরাজি, ঘাস ও ফুল দিয়ে। ক্লাস রুমের চেয়ার টেবিলের বয়স বেড়ে গেছে,নতুন চামড়ায় রংয়ের পচন ধরেছে ।
দেখে মনে হচ্ছে ধুলির আস্তরনে জরাজীর্ণ।প্রিয় রুম আজ হয়ে গেছে অচেনা।আবাসিক হল গুলি আজ মাকড়োসার করদ রাজ্যে পরিনত হয়েছে।অতি কষ্টে অর্জিত প্রিয় রুম আজ হয়ে গেছে আলোহীন অচেনা গুহা। শ্রেণি কক্ষের বেঞ্চ গুলো একাকী নিরালায় কারো অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
শ্রেণি কক্ষের রসালো পাঠদান,শিক্ষকের ব্যবহারিক শিক্ষা কিংবা জীবন বদলানো গল্প শোনা আজ দারুন মিস করছে ছাত্র-ছাত্রী কিংবা শিক্ষকরা।বিদ্যালয়ের দেয়ালের রং কিছুটা মলিন হয়ে গেছে।ফুল না ধরা গাছে ফুল ধরেছে,রোগা বৃক্ষটির মরন হয়েছে,নতুন সবুজ বৃক্ষ সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে নবরুপে।এ যেন অচেনা এক নতুন প্রাঙ্গন।এই ক্যাম্পাস চিনতে হয়তো অনেকেরই কষ্ট হবে।
ভার্চ্যুয়াল শিক্ষা কার্যক্রম না থাকায় এবতেদায়ী,প্রাক প্রাথমিক,প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা আজ ভুলে গেছে বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের কথা। পড়াশোনার কথা না হয় নাই বা বললাম। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলেও অনেক শিক্ষার্থী স্মার্টফোন, ইন্টারনেট,অর্থসংকট ও নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে যুক্ত থাকতে পারেনি।
গণসাক্ষরতা অভিযানের সাম্প্রতিক জরিপ থেকে জানা যায়। দীর্ঘ সময় অনলাইন ও সংসদ টিভিতে ক্লাস চললেও ডিভাইস ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ৬৮% শিক্ষার্থীর কাছে সেই সেবা পৌঁছায়নি।গণসাক্ষরতা অভিযান সারাদেশের শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ প্রায় ৩,০০০ জনের ওপর জরিপ পরিচালনা করে দেখেছে যে প্রায় ৬৯% শিক্ষার্থী করোনাকালে দূর-শিক্ষণে অংশ নিতে পারেনি।
অনেক শিক্ষার্থী আবার স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টা হেডফোন দিয়ে ক্লাস করায় শ্রবণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে, ঘুম কম হচ্ছে এবং আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তন আসছে। পরীক্ষা বাতিল থাকায় পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ নাই বললেই চলে।
এইচএসসিতে অটোপাস অনেকের কাছে অসন্মানের । অটোপাস নয়, তারা পরীক্ষা দিতে চায়। বেসরকারি স্কুল-কলেজ,মাদ্রাসা অনেকটাই দেউলিয়ার পথে। । এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের হাজারো শিক্ষক চাকুরি হারিয়ে অন্য কোন বেঁচে থাকার মত পেশা বেছে নিয়েছেন।আর্থিকদিক বিবেচনা করলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কিছুটা ভাল আছেন।আর সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বাম্পারে আছেন সন্দেহ নাই।কিন্তু আনন্দহীন ক্যাম্পাস কিংবা শিক্ষার্থী ছাড়া তারা ও দিশেহারা।
কারন শিক্ষার্থী ছাড়া শিক্ষকদের কি মূল্য আছে? করোনার প্রকোপ যে হারে বাড়ছে, মৃত্যু যে হারে বাতাসে লাশের গন্ধ বাড়াচ্ছে তাতে প্রিয় শিক্ষা প্রাঙ্গনে প্রাণের মেলার সুর কবে আসবে সেটি আজও অনিশ্চিত।হয়ত আবারো আরেকটি শিক্ষাবর্ষ শিক্ষার আলো না ছড়িয়ে চলে যাবে। আবারও অটোপাস হবে। আবারো অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকবে লক্ষ-কোটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর অভিভাবক প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত শিক্ষাঙ্গনের দিকে।
লেখক- শিক্ষক, বিভাগীয় প্রধান,আয়েশা (রা:) মহিলা কামিল (অনার্স,এম.এ) মাদ্রাসা।সদর,লক্ষীপুর।