ধারাবাহিক মূল্যায়নে শিক্ষকদের অনীহা
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ৬৬ শতাংশের বেশি শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের রেকর্ড সংরক্ষণ করেন না। এতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের শিখন ঘাটতি নিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে তাদের উচ্চশিক্ষা। অনেকে ঝরেও পড়ছে। পরবর্তী সময়ে কর্মক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এই ঘাটতি।
শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নে শিক্ষকদের এই অনীহার বিষয়টি উঠে আসে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অ্যাকসেস অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাশিউর্যান্স ইউনিটের (একিউএইউ) ‘একাডেমিক সুপারভিশন’ প্রতিবেদনে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের বিভিন্ন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তদারকি শেষে গত ২ মার্চ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন সঠিকভাবে সংরক্ষণ করেন না ৬৬.১১ শতাংশ শিক্ষক। এর মধ্যে আংশিকভাবে রেকর্ড সংরক্ষণ করেন ৪৩.৩২ শতাংশ শিক্ষক। মূল্যায়ন রেকর্ড একেবারেই সংরক্ষণ না করা শিক্ষকের হার ২২.৭৯ শতাংশ।
শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বইনির্ভর পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়তি জ্ঞান, মূল্যবোধ ও দক্ষতা তৈরি হয়। তাদের শিখন ঘাটতি নিরূপণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পরবর্তী শ্রেণিতে শিখন ঘাটতি বেড়ে যায়। এতে পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে। দক্ষতা তৈরি না হওয়ায় কর্মক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে পড়ে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ কোর কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক আহসান বলেন, শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নে শিক্ষকদের যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন, এতে ঘাটতি রয়েছে। তাঁরা এখনো নম্বরভিত্তিক মুখস্থনির্ভর মূল্যায়নে অভ্যস্ত। যেসব বিষয়ে ব্যাবহারিক রয়েছে, সেগুলোতে নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রেও এমন চিত্র দেখা যায়।
তারিক আহসান বলেন, শিখন ঘাটতি সঠিকভাবে পরিমাপ করতে না পারায় প্রতিটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। দক্ষতার মূল ভিত্তি না থাকায় উচ্চশিক্ষায় গিয়েও এ ঘাটতি আরো বেড়ে যায়। সেখানে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা বা মানবিকভাবে অবদান রাখতে পারে না। জ্ঞান সৃষ্টির ঘাটতি থাকায় এসব শিক্ষার্থী চাকরি খুঁজতে বেশি সক্রিয় হয়। তবে কর্মক্ষেত্রেও তারা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কম বেতনে চাকরি করে। প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এখনো মুখস্থনির্ভর জানিয়ে তিনি বলেন, ধারাবাহিক মূল্যায়নকে আংশিকভাবে বাস্তবায়নের পরিবর্তে মূল মূল্যায়ন পদ্ধতিতে নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণে প্রতিদিন বা সপ্তাহের যে কার্যক্রম আছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
শিখন ঘাটতির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না মাধ্যমিকের ২৯.৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করতে কোনো পদক্ষেপ নেই ৭.৬৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করার পরও তাদের শিখন ঘাটতি পূরণে উদ্যোগ নেয় না ২১.৯৩ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
শিক্ষার মানোন্নয়নে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একাডেমিক সুপারভিশনে (তত্ত্বাবধান) গুরুত্বারোপ করা হয়। এই তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের শিখন শেখানো পদ্ধতিসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকা সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ঘাটতি নিরূপণ করে এর উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া। তবে প্রতি মাসের প্রতিবেদনে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গাফিলতির চিত্র দেখা গেলেও প্রতিকারে কোনো পদক্ষেপ নেই।
একিউএইউ উপপরিচালক নূরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দুর্বল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা থেকে উত্তরণে বা ব্যবস্থা গ্রহণে সেসিপের যুগ্ম পরিচালকের কাছে প্রতি মাসের প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এ ছাড়া বছরে একবার অংশীজনদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করা হয়, যেখানে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিব উপস্থিত থাকেন। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাটাগরি নির্ধারণ করে বই প্রকাশ করা হয়। বইয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা উত্তরণে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয়। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রগ্রামের (সেসিপ) যুগ্ম প্রগ্রাম পরিচালক প্রফেসর শামসুন নাহার।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেসিপের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সেসিপের আওতাধীন এসব শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রকল্পভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাঁরা খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। আবার এসব শিক্ষা কর্মকর্তার জরিপ কতটুকু গ্রহণযোগ্য, তা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও নেই। এসব কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। এই সুযোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেনতেনভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
মাউশির মাধ্যমিক শাখার উপপরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো ধরনের প্রতিবেদন আমাদের কাছে আসে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তদারকির দায়িত্বে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা আছেন। তবে এসব অসংগতি নিয়ে আমাদের কাছে চিঠি এলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রতিবেদন বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০০৮ সাল থেকে মাধ্যমিকে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও নিজস্ব শিক্ষক দিয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে ব্যর্থ ৩৮.৭৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১৯.৭৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করে, বাইরে থেকে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করা প্রতিষ্ঠানের হার ১৮.৯৯ শতাংশ।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর স্বমূল্যায়ন ছকে দেখা যায়, ছয় হাজার ৮৭২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে না। ডি ক্যাটাগরির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫৪টি ও ই ক্যাটাগরির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১০টি। ডি ও ই ক্যাটাগরিতে থাকা বিদ্যালয়গুলো তাদের ব্যর্থতার কারণ জানিয়ে মাউশিতে ছয় মাসের মধ্যে উত্তরণ পরিকল্পনা পাঠাতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হলে বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি স্থগিত ও এমপিও বাতিলের বিধান রয়েছে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৪/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়