ধর্মীয় শিক্ষা উপার্জনের মাধ্যম হতে পারে কি?
মুফতী ফয়জুল্লাহ আমানঃ ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম। প্রতিটি মানুষের দুনিয়া আখিরাতের সাফল্য রয়েছে এই ধর্মের মাঝে।দুনিয়াবিহীন আখিরাত বৈরাগ্য। বৈরাগ্যকে ইসলামে হারাম করা হয়েছে। ইসলামে কোনো বৈরাগ্য নেই।ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থায় এজন্যই দুনিয়া আখিরাত উভয়টির সমন্বয় থাকা একান্ত আবশ্যক।
আমাদের দেশে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে যে শিক্ষা দেয়া হয় সেখানে পার্থিব শিক্ষার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। কেবল ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হলে ইসলামের ভারসাম্য সেখানে থাকে না। যেই প্রজন্ম কেবল একমুখী শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠবে সাধারণ সমাজে চলা তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।
সাধারণ শিক্ষা না থাকলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সমস্যা। কারণ উপার্জনের জন্য যদি কোনো শিক্ষা গ্রহণ না করে তাহলে ধর্মীয় শিক্ষাকেই তার উপার্জনের মাধ্যম বানাবে। আর প্রিয় নবি সা. স্পষ্টভাবেই এটিকে নিষিদ্ধ করেছেন। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. ইরশাদ করেন,যে ব্যক্তি দুনিয়ায় উপার্জনের উদ্দেশ্য ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করলো সে কাল কেয়ামতে বেহেস্তের ঘ্রাণও পাবে না। [আবু দাউদ] এ হাদিস থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মীয় শিক্ষাকে উপার্জনের মাধ্যম বানানো যাবে না। এখন যে ছেলেটা ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো শিক্ষা অর্জন করেনি সে চলবে কিভাবে? তাকে তো ধর্মীয় শিক্ষাকেই উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
কওমি মাদ্রাসার যে কোনো ছাত্রকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কেন মাদ্রাসায় পড়ছ? সে বলবে, আমি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইলম হাসিল করছি। এই মানসিকতা নিঃসন্দেহে খুব ভালো। পার্থিব কোনো স্বার্থ নেই, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনি ইলম হাসিল করা। কিন্তু তুমি জীবিকা উপার্জন করবে কিভাবে? এমন প্রশ্ন করলে, খুব বিরক্ত হয় মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক। তারা এর উত্তর দেন আল্লাহই আমাকে খাওয়াবেন।
আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করব।এই তাওয়াক্কুল ও ভরসা নিঃসন্দেহে অনেক ফজিলতের বিষয়। কিন্তু এভাবে কোনো উপায় গ্রহণ না করে তাওয়াক্কুল করা কি ইসলামে বৈধ? কোনো উপায় গ্রহণ না করে অন্যের পকেটের দিকে তাকিয়ে জীবন পার করে দেওয়া ইসলামিক দৃষ্টিতে কোনো সম্মানের কাজ নয়। নিজের উপার্জিত অর্থের চেয়ে উত্তম কোনো রিযিক নেই। কেউ দান করলে তা খেয়ে জীবন চালানো এক অনিশ্চয়তার জীবন। অসম্মানের জীবন। ছাত্র থাকতে এমন দান গ্রহণ কোনো অসম্মানের নয়। দরিদ্র ছাত্ররা অবশ্যই এই দান গ্রহণ করতে পারে। এভাবে ইলম শেখায় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা হলো,একটা ছেলে দীর্ঘ এক যুগ পড়াশোনা করে তারপরও তার জীবিকার জন্য অন্যের অর্থের দিকে লোলুপ হয়ে থাকতে হয়। কেউ যাকাত ফিতরা দিলে সেই টাকায় তার সংসার চলবে। তার ছেলে মেয়ে পরিবারের ভরণ পোষণ চালাতে হবে এভাবে খয়রাতের টাকায়। অনিশ্চিত এক দুঃখময় জীবন, এটা কি ইসলামের শিক্ষা? ইসলাম এমন তাওয়াক্কুল তো শিক্ষা দেয়নি।
এক বেদুইন প্রিয় নবির সা. কাছে এসেছিলেন উটে সাওয়ার হয়ে। মসজিদে নববির বাইরে উট রেখে এসে সে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি বাইরে উট রেখে এসেছি। উটটি ছেড়ে দিয়ে আমি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করছি। রাসুল সা. বললেন,না না তুমি উটটি বেঁধে রেখে তারপর আল্লাহর উপর ভরসা করো, উট ছেড়ে দিয়ে তাওয়াক্কুল নয়। [তিরমিযি] এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করার অর্থ এ নয় যে, উপায় উপকরণ অবলম্বন করবে না। বরং সব উপায় উপকরণ অবলম্বন করার পর উপায় উপকরণের উপর আস্থা না রেখে মহান আল্লাহর রহমতের উপর আস্থা ও ভরসা রাখবে। এখন আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে যে তাওয়াক্কুল শেখানো হচ্ছে, তা তো উট ছেড়ে দিয়ে আল্লাহতে তাওয়াক্কুল এর মতো। জীবিকা উপার্জনের কোনো শিক্ষা সেখানে নেই। একটা ছাত্র মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করার পর যত মেধাবী ছাত্রই হোক- মসজিদ মাদ্রাসার বাইরে তার কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। এজন্যই অসংখ্য মাদ্রাসা মসজিদ গড়ে উঠছে আমাদের দেশে।
ঢাকা শহরে একেকটা গলিতে দশ বারোটা মাদ্রাসা। একটি বিল্ডিংয়েও ছয় সাতটি মাদ্রাসার নজির আছে। কারণ মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করার পর তাদের যাবার কোনো জায়গা নেই। মাদ্রাসার পড়াশোনা শেষ করে তাকে অবশ্যই আরেকটি মাদ্রাসা দিতে হবে অথবা মসজিদ তৈরি করতে হবে তা না হলে না খেয়ে মরতে হবে। আমরা গর্ব করে বলি, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মসজিদ মাদ্রাসা আমাদের দেশে। কিন্তু এটা ভাবার বিষয়, ইসলামিক দৃষ্টিতে এত অধিক অপরিকল্পিত অপ্রয়োজনীয় মাদ্রাসা মসজিদের ফায়দা কতটুকু হচ্ছে? দশটা ছোট ছোট মসজিদ না বানিয়ে একটা বড় মসজিদ বানালে সেটি সমাজের জন্য অধিক উপকারী হতো। মসজিদে সমাজের মানুষ জমায়েত হবে, সেখানে নানান ধর্মীয় ও সামাজিক প্রোগ্রাম হবে এবং মসজিদ কেন্দ্রিক বিভিন্ন সামাজিক সেবা প্রদান করা হবে, এমনই হওয়ার কথা ছিল মসজিদগুলো। আরব, ইউরোপ, তুরস্ক ও অন্যান্য অঞ্চলে এভাবেই মসজিদ নির্মাণ হয়।
আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপরিকল্পিত মসজিদের সামাজিক কল্যাণ কতটুকু। রাস্তার এপারে একটা মসজিদ, ওপারে আরেকটা মসজিদ। অসংখ্য মসজিদ তৈরি করা হয়েছে দ্বন্দ্ব করে। এক মসজিদের মুসল্লিদের মাঝে দ্বন্দ্ব হয়েছে, তারা দুই ভাগ হয়ে পাশেই আরেকটা মসজিদ তৈরি করে ফেলেছে। মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিনের অভাব নেই। যে কোনো মসজিদে ইমাম মুয়াজ্জিন খতিব শুধু নয় খাদেমের চাকরির জন্য বিরাট লাইন পড়ে যায়। এক মসজিদে খাদেম নিয়োগ দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। দেখা গেল সত্তরের অধিক আবেদনপত্র জমা পড়েছে; তাদের প্রত্যেকেই মাওলানা, অধিকাংশই মুফতী, অনেকে মুফাসসিরও আছে।
খতিব নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলে সাধারণ একটি মসজিদেও পাঁচ ছয়শ আবেদনপত্র জমা পড়ে যায়। মসজিদ কমিটিকে বাছাই করতে হিম শিম খেতে হয়। অন্য কোন উপার্জনের সুযোগ না থাকায় অনেক সময় কমিটির গোলামী করতে বাধ্য হন ইমামরা। হক কথা বলার সাহস হয় না। রমজানে তারাবি পড়িয়ে টাকা নেওয়া নাজায়েয ফতোয়া দেওয়া হয় প্রতিটি মাদ্রাসা থেকে। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকটা মসজিদে তারাবির নামাজের ইমামতির জন্য যে পরিমাণ হাফেজ মাওলানা মুফতীদের ভীড় হয় তা সত্যি অবাক করা। দেখা যাচ্ছে, ফতোয়া কাজে আসছে না। সবাই তারাবি পড়িয়ে টাকা নিচ্ছেন। ইলমে দিনের মাধ্যমে উপার্জন করছেন। মাদ্রাসা মসজিদের বাইরেও ওয়াজ মাহফিল ও ইউটিউবে ধর্মীয় কন্টেন্ট তৈরি করে অর্থ উপার্জন করছে। এসব কেন হচ্ছে? কওমি শিক্ষা কারিকুলামের অসম্পূর্ণতার কারণেই এসব ঘটছে।
একটি মাদ্রাসার ছাত্রভর্তিকালীন অঙ্গিকারনামার একটি ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে।অঙ্গীকারনামার প্রথম দফায় উল্লেখ আছে ‘আমি একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভ ও পরকালের নাজাতের উদ্দেশ্যে ‘ইসলামি দ্বীন’ হাসিল করিব। জীবিকা অর্জনের অবলম্বন হিসেবে উহাকে ব্যবহার করিব না।’এই নিবন্ধ লেখার মূল প্রেরণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত এই পোস্ট।আজকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষও পর্যবেক্ষণ করছে।তাদের জিজ্ঞাসাসমূহ অস্বাভাবিক নয়।কারণ মাদ্রাসাগুলো থেকে শিক্ষালাভ করে যারা বের হচ্ছেন তারা কি নিজেদের ওয়াদা ভঙ্গ করছেন না? যা হাদিসের নির্দেশনা অমান্য করাকেই প্রতিষ্ঠিত করে।
কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম দেওবন্দকে ফলো করার দাবি করে। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে, দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতারাও এভাবে কর্মহীন ধর্ম চর্চার কথা ভাবেননি। ঔপনিবেশিক আমলে আজ থেকে দেড়শ’ বছর আগে দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইসলামি জ্ঞানের সংরক্ষণের জন্য। কেবল এর উপর নির্ভর করে জীবন জীবিকার চিন্তা তারা করেননি। মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি অন্য শিক্ষা অর্জন করে আয় উপার্জন করবে আর পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে নিঃস্বার্থভাবে ইসলামের প্রচার প্রসারে কাজ করবে, এটাই ছিল দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের লক্ষ্য। এসব বিষয় নতুন করে আলোচনায় আসা প্রয়োজন। কওমি মাদ্রাসার তরুণ ছাত্র শিক্ষকদের অবশ্যই এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সবাইকে সঠিক সমঝ নসিব করুন। আমিন।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/০৬/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়