“মুক্তমত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
দেশে কেন একটি জাগ্রত বুদ্ধিজীবী সমাজ দাঁড়াল না
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাঃ বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকায় অসুবিধা হয় শাসকের। বুদ্ধিজীবীরা বরাবর শিকার হয়ে থাকেন শাসকের ক্ষমতা বীভৎসতার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজে সেরকম বুদ্ধিজীবী কোথায়? সবাই বলে, সেরকম বুদ্ধিজীবী আর নেই আমাদের।
কিন্তু বলে না সেরকম বুদ্ধিজীবী কেন আর নেই আমাদের। এখনকার বাস্তবতা হলো, ‘বুদ্ধিজীবী’ বা ‘নাগরিক সমাজ’ তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবীদের অধঃপতনের ইতিহাস হয়তো অনেক বড় করেই বলা যাবে। তবে সে কথায় পরে আসা যাবে।
আজ বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন, আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিনটিতে জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের শিকার তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে। তারা তাদের এদেশীয় দোসরদের নিয়ে শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ বহু মানুষকে হত্যা করে। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পর রাজধানীর রায়েরবাজার ইটখোলা, মিরপুরের বধ্যভূমিসহ ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের চোখ-হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়।
প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের একটি বইয়ের নাম ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’। বইটি ১৯৭১-এ যে চেতনায় ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিল, অসংখ্য মানুষ সব হারিয়েছিল, সেই চেতনার বিপর্যয়ের ইতিবৃত্ত।
বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে ঘর থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কারণ তারা স্বাধীনতার আগের তিন দশক ধরে জাতির বিবেককে জাগিয়ে তুলতে লেখা-গান, চিকিৎসা, অভিনয় ও শিক্ষার মাধ্যমে দেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত রেখেছিলেন। পাকিস্তানিরা বুঝেছিল তারা হারবে। তাই বাঙালি জাতির ভিত্তি নষ্ট করে দিতে স্বাধীনচেতা, মুক্তমনা ও আদর্শনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের ধ্বংস করেছে তারা। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ফ্যাসিবাদী ও অত্যাচারী একনায়করা সবসময় বুদ্ধিজীবীদের নির্মূল করতে চেয়েছে। ইতালিতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির রাজত্বের সময়ে অসংখ্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে কেন একটি জাগ্রত নাগরিক সমাজ বা একটি সক্রিয় বুদ্ধিজীবী সমাজ দাঁড়াল না সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। তবে বোঝা যায় যে, স্বাধীনতার ঠিক পরপর প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হারিয়ে দেশটায় সেভাবে কোনো বুদ্ধিজীবীর জন্য জমিন তৈরি করার প্রচেষ্টাই নেওয়া যায়নি। আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘যে কোনো দেশের বুদ্ধিজীবীরা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অসম্মত হন, সেই দেশটির দুর্দশার অন্ত থাকে না। বাংলাদেশ সেই রকম একটি দুর্দশাগ্রস্ত দেশ। এ দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উদ্যোগ, কোনো প্রয়াস কোথাও পরিদৃশ্যমান নয়।’
রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত বাংলাদেশে সব পেশাজীবীই আজ বিভক্ত। শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, কৃষিবিদ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক এবং কবি, সাহিত্যিক সবাই রাজনৈতিক লাইনে বিভাজিত। তাই বুদ্ধিজীবীরাও এখন দলীয় বুদ্ধিজীবী। কেউ এ ফোরামের তো কেউ সেই ফোরামের।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে একটি উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশের চেতনা ছিল। এ চেতনানির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। রাজনীতিবিদরাও সেই চেতনাকেই সামনে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এখন সেটা পাল্টে গেছে। বুদ্ধিজীবীরা এখন রাজনীতির অধীনে থাকা নানা শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থেকে ফাইফরমায়েশ খাটেন আর সুবিধা নেন। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি, একইভাবে বুদ্ধিজীবীরাও জাতির মানস গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেননি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মুক্তস্বর, মুক্তকণ্ঠ তেমনভাবে আর দেখা যায় না।
১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের ক্ষমতা চলে যায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তির কাছে। সামরিক শাসকরা একেবারে চরিত্রহীন করে ছেড়েছে বুদ্ধিজীবীদের। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী রাতারাতি বনে যান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শন প্রচারক। জেনারেল জিয়ার আমলে শুরু হওয়া এ বুদ্ধিজীবী কেনাবেচার প্রক্রিয়া আরও বেশি করে করেছেন জেনারেল এরশাদ। কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী দাস হয়েছিলেন এরশাদের। গণতন্ত্রের আমলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই এখন আর সেরকম বুদ্ধিজীবী পাওয়া যায় না। সমাজ পরিবর্তনে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা এখন খুবই নগণ্য।
কারণটা রাজনৈতিক। আমাদের রাজনীতি, দল এবং নেতৃত্ব পুরোপুরি মানুষ থেকে দূরে। ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থাকা রাজনীতি বুদ্ধিজীবীদের নিজেদের ভৃত্য বানিয়ে ছেড়েছে ক্ষমতার ছোটখাটো ভাগ দিয়ে। কাউকে উপাচার্য করে, কাউকে একটা মহাপরিচালক বানিয়ে, চেয়ারম্যান করে, কমিশনের সদস্য বানিয়ে বা পরিচালক করে বা বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে ছোটখাটো চাকরি দিয়ে।
এ দেশের দলীয় রাজনীতি সব মতাদর্শকে শ্রদ্ধা করে না। ইতিহাস, ভিন্ন মতাদর্শ, বিরোধিতা—সব মিথ্যে, সত্যি শুধু তাদের নিজেদের তৈরি করা ধারণাগুলো। সব দলের বুদ্ধিজীবীরাই এখন সত্যটাকে আড়াল করার কারিগর। নিরপেক্ষতার চোখে ঠুলি পরিয়ে ঘৃণা আর ভয় দিয়ে চালাচ্ছে তাদের ধারণা তৈরির চাকরি। বুদ্ধিজীবী মাত্র উপদেষ্টা, বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতির শুভচিন্তক নন, তারা রাজনৈতিক কুমন্ত্রণাদাতা।
ক্ষমতাহীন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণির পক্ষে সংগ্রামের পথ দেখানো বুদ্ধিজীবী এখন বিরল। অথচ বুদ্ধিজীবী মানেই হলো, তারা বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোটা এমনভাবে বদলানোর কথা বলবেন, যাতে সামাজিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনাগুলো দূর করা যায় এবং বঞ্চিতরা নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রে অংশ নিতে পারে।
আমাদের এখনকার দাপ্তরিক বুদ্ধিজীবীদের গৌরব হলো তারা প্রথমে দলীয়, তারপর তাদের বুদ্ধিজীবিতা। এরা ক্ষমতার ক্ষীর-ননী খাওয়া নধর বুদ্ধিজীবী। ভিন্নমত নিধন, দুর্বৃত্ত পোষণ, ধর্ষণ; শাসন-নিষ্ক্রিয়তা, দরিদ্র-নিপীড়িতদের ক্ষমতায়নের বিপরীতে সমাজের দুর্বৃত্ত লালনকারী কাঠামোটা মজবুত করার মতো কুকর্মের শৃঙ্খলা কখনো এ দাপ্তরিক বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ তো দূর, সামান্য সমালোচনাতেও প্রণোদিত করে না।
এরকম করতে করতে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা মতাদর্শগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টিহীনতায় শীর্ণ। দলীয় প্রতাপজনিত অন্ধতার আচ্ছাদন দূর করে সত্য বলার লোক নেই আজ। এদের দর্শন প্রশ্ন করা নয়, আনুগত্য। দীর্ঘ অভ্যাসে বুদ্ধি নিষ্ক্রিয় ও দৃষ্টি আচ্ছন্ন এ বুদ্ধিজীবীরা অসুস্থ এবং সে ব্যাধির নিরাময় অতিকঠিন। দরিদ্র, অবদমিত, ক্ষমতাবৃত্তের বহু দূরে থাকা নিষ্পেষিত জনতার পক্ষের কণ্ঠস্বর এরা নন।
তাহলে করণীয় কী? এ করণীয়টা ঠিক করবেন বুদ্ধিজীবী হিসেবে যারা নিজেকে সমাজে উপস্থাপিত করতে চান তারাই।
এসব কারণে আমাদের সমাজের এক অংশের মানুষের কাছে বুদ্ধিজীবীরা এখন বিরক্তি আর হাসির পাত্র। কোথায় বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতা কেন্দ্রের লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হবেন তা নয়, উল্টোটা হলো তারা নিজেরাই ক্ষমতা কাঠামোর ন্যারেটিভ লিখছেন। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের অনুসারী বুদ্ধিজীবীরা সেই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেন।
ক্ষমতার কাছে থাকা এক অদ্ভুত নেশার মতো। মানুষকে মারিয়ে, নিয়মকে তুচ্ছ করে হুটার লাগানো বিশালকায় স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল ছুটে যায় সাইরেন বাজিয়ে। সেগুলোর অনেকগুলোতেই বসা থাকেন ভৃত্য বুদ্ধিজীবীরা। একদিকে রবীন্দ্রসংগীত আর অন্যদিকে ডিসকো নাচ উভয়ে পারদর্শী এরা।
বাস্তবতা হলো, প্রতিটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকা বা আসার জন্য নির্ভর করে থাকে আদর্শ ছাড়া বাকি সবকিছুর ওপর। এ বুদ্ধিজীবীরাও তাই। এদের কোনো আদর্শ নেই, নেই মানুষের প্রতি কোনো মমতা। স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্ণ হতে চলল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, বিপুল দ্রুততায় বাংলাদেশের সমাজ মুক্তচিন্তা থেকে ধর্মমুখী চিন্তার কানাগলিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে। কিন্তু এ নিয়ে খুব কম বুদ্ধিজীবীই কথা বলেন।
সুবিধাবাদের রাজনীতির কারণে মুক্তচিন্তা নয়, একমুখী ধর্মাশ্রয়ী চিন্তা, এমনকি হিংস্রতাও সমর্থন পাচ্ছে। একসময় ধর্মনিরপেক্ষতা ও যুক্তিবাদের সংস্কৃতি প্রসারের কথা বলতেন তারা এখন নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছেন। যেন লুকিয়ে ফেলছেন নিজেদের। তারা ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু যুক্তি-বুদ্ধি-গ্রাসকারী অন্ধ মতবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস পান না। আজ নির্লোভ, উদার, অসাম্প্রদায়িক প্রগতিমুখী অবস্থান ঊর্ধ্বে তুলে ধরার মতো বুদ্ধিজীবীর বড় অভাব।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এটাই বড় বেদনার জায়গা। আজ আমরা বিমর্ষ যতটা না একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হারিয়ে, তার চেয়েও বেশি এখনকার জাগ্রত ভৃত্য বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয়তায়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১২/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়