ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের সর্বাঙ্গে ব্যথা
নাহিয়ান রেহমান রাহাতঃ ২০১৭ সালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সরকারি সাত কলেজের নানা সংকট নিয়ে আন্দোলন চলছিল। তখন প্রধানমন্ত্রীর এক কথায় কোনো রকম প্রস্তুতি ও আয়োজন ছাড়া কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। অধিভুক্ত করার আগে সাত কলেজের শিক্ষার মান উন্নয়নের স্লোগান তোলা হয়েছিল কিন্তু বাস্তবে উন্নতির স্থলে হলো অবনতি। শুরু হলো সেশনজটের নতুন সংকট। সেই সংকট দূর করতে দিনের পর দিন আন্দোলন হলো নীলক্ষেতে। এর মধ্যে ২০২০-এ করোনা এলো। লম্বা বন্ধে সেশনজট আরও বেড়ে গেল।
২০২১-এর শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন সমাধান সূত্র আনল–১২ মাসের কোর্স শেষ হবে ৮ মাসে। ফল যা হওয়ার তা হলো– ১২ মাসের কোর্স যারা ১৩ মাসেও শেষ করতে পারে না, তারা ৮ মাসে কোর্স শেষ করতে গিয়ে শ্রেণিকক্ষের পাঠদানই প্রায় উঠে গেল। শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের ভয়ানক সংকটে এলোমেলো হলো ক্লাস শিডিউল। কোর্স শেষ না করতে পেরে একটি সাজেশন দিয়ে নিয়ে নেওয়া হলো ইন কোর্স ও টেস্ট পরীক্ষাগুলো।
কলেজগুলোর প্রায় সব শ্রেণিকক্ষই পুরোনো। কয়টাতে যে মাল্টিমিডিয়া সংযোগ আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। আবার কখন যে সিলিং ফ্যান খুলে মাথার ওপর পড়ে– এমন আতঙ্কও অনেক ক্ষেত্রে আছে। ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। লাইব্রেরি সেমিনারে নেই পর্যাপ্ত বই; নেই স্বতন্ত্র পরীক্ষার হল। অপ্রতুল আবাসন সত্ত্বেও পর্যাপ্ত পরিবহন সেবা নেই। এরই মধ্যে চলছে সরকারি ছাত্র সংগঠনের অপরাজনীতি ও দখলদারিত্ব।
সম্প্রতি ঢাকা কলেজের শ্রেণিকক্ষ সংকট সমাধানে ক্যাম্পাসে একটি দশতলা একাডেমিক ভবন করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের দুর্নীতির কারণে সেখানে লিফট ব্যবস্থা না থাকায় পাঁচতলার ওপরের অংশ অব্যবহৃত। এটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটেনি।
এ ছাড়াও ক্যাম্পাসগুলোতে প্রতি বছর নামে-বেনামে, রসিদ দিয়ে-না দিয়ে নেওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের ফি। এর মধ্যে অন্যতম ল্যাব ও বিভাগ উন্নয়ন ফি। এমনকি বিভাগগুলোর পিয়ন ও স্টাফদের বেতনও নেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।
ক্যাম্পাসগুলোতে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। আবার সেই পরিবেশ যেন তৈরি না হয়, তার জন্য পরিকল্পিতভাবে ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন’ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে কলেজগুলো পরিচালনায় গণতান্ত্রিকতার লেশমাত্র নেই; জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা তো দূরস্থান। একই কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রণয়ন করা কোনো নীতি শিক্ষার্থীবান্ধব হয় না।আরও দুর্ভাগ্যজনক, সাত কলেজে বিরাজমান এ বাস্তবতার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যেহেতু কোনো সম্পর্ক নেই, কলেজগুলোর জন্য প্রণীত তাদের সিলেবাস, পরীক্ষা ও রুটিন-সংক্রান্ত নীতিমালাও নানা প্রকার অসংগতিতে পূর্ণ।
সম্ভবত এসব কারণেই– অনেকটা মাথাব্যথার দাওয়াই হিসেবে মাথা কেটে ফেলার নিদানের মতো– শিক্ষার মান উন্নয়নের স্লোগান তুলে সাত কলেজে কমানো হচ্ছে বিভাগগুলোর আসন সংখ্যা। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ কমে যাবে মধ্যবিত্তের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ; বেড়ে যাবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান ধনী-দরিদ্র বৈষম্য।
এত সংকটের মধ্যেও শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসছেন। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সংকট, ঢিলেঢালা ভাব, সাত কলেজের শিক্ষক সংকট ইত্যাদি কারণে তাঁদের পরীক্ষার ফল পেতে অপেক্ষা করতে হয় অন্তত ৮-৯ মাস। অদ্ভুত শোনালেও সত্য, এই ৮-৯ মাস শিক্ষার্থীরা পরবর্তী বর্ষের ক্লাস শুরু করেন। পরপর দুটি ইন কোর্স পরীক্ষা দেন, টেস্ট দেন। এমনকি কখনও কখনও পরের বছরের সমাপনী পরীক্ষার ফরম ফিলআপও সেরে ফেলেন। তারপর আসে আগের বছরের রেজাল্ট। এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা বুঝে উঠতে পারেন না– আগের বছরের মান উন্নয়নের প্রস্তুতি নেবেন, না পরের বছরের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন।
এমন জটিলতার বাইরেও দেখা যায় ভয়াবহ ফলাফল বিপর্যয়। কোনো কোনো বিভাগে দেখা যায়, পাঁচজন মাত্র প্রমোশন পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-অবহেলা, যথাযথ ক্লাস না হওয়া, শিক্ষক সংকট, একাডেমিক ক্যালেন্ডার এবং সাত কলেজের শিক্ষকদের সঠিক প্রক্রিয়ায় খাতা না দেখা এর জন্য দায়ী। এ ছাড়া প্রমোশনের নীতিমালাও অদ্ভুত। কোনো পরীক্ষায় কেউ যদি তিনটি কোর্সে ফেল করেন কিংবা সব কোর্সে পাস করেও কারও যদি মোট জিপিএ [বর্ষ ও বিভাগভিত্তিক] ২.০০, ২.২৫ ও ২.৫০-এর নিচে থাকে তাহলে সেই শিক্ষার্থী প্রমোশন পাবেন না।
রেজাল্ট চ্যালেঞ্জ করেও বেশিরভাগ সময় কোনো ফল পাওয়া যায় না, শুধু অর্থ ব্যয়। তার ওপর প্রশাসনিক সব কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে পরিচালিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ওখানে ঘুরতে ঘুরতে ব্যাপক শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয়। অনেকেরই হয়তো জানা আছে, রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের হয়রানির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য সরকারি অফিসের হয়রানির কোনো পার্থক্য নেই। রেজিস্ট্রেশন ও মান উন্নয়ন খরচও নেহাত কম নয়। তাই সাত কলেজের জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ভবন নির্মাণও কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি।
লেখক শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০২/০৭/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়