স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত তিন সপ্তাহে ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫৪ জন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগেই ২ লাখ ৩৮ হাজার ২১৯ জন। সরকারি হিসাবে এই বিভাগে কোনো মৃত্যু হয়নি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫ হাজার ১৮৩ জন; সর্বোচ্চ মারা গেছেন ৪৫ জন। সবচেয়ে কম ৬ হাজার ৫৭২ রোগী সিলেট বিভাগে। এ বিভাগে কারও মৃত্যু হয়নি। ময়মনসিংহে ১৫ হাজার রোগীর মধ্যে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিন শিশু হাসপাতালে দেখা যায়, নিচতলার ১ নম্বর ওয়ার্ডে ঠান্ডাজনিত অসুস্থতার কারণে ভর্তি করা হয়েছে সাড়ে চার বছরের শিশু আমানউল্লাহকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার নিউমোনিয়া হয়েছে। রক্তে অক্সিজেনের লেভেল কম থাকায় হেডবক্সে মাথা ঢুকিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। খাবার খাওয়ানোর জন্য নাকে নল এবং ইনজেকশন, স্যালাইন পুশ করতে মাথায় ক্যানুলা করে দেওয়া হয়েছে।

শিশুটির মা আয়েশা বিনতে ইসলাম বলেন, আমান ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় গত তিন মাস শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। হঠাৎ ঠান্ডা-কাশি, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের কথা জানান। এর পাশের শয্যায় একই সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছে চার মাসের আরিফুল ইসলাম। চার দিন আগে আরিফের ঠান্ডা-জ্বর ও সঙ্গে পাতলা পায়খানা। গ্রামের বাড়ি সাভারে। সেখানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। তবে শারীরিক পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসকরা এখানে রেফার করেন। এখানে আসার পর নিউমোনিয়া হয়েছে জানিয়ে ভর্তি করা হয়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে সে।

তবে শীতজনিত রোগীর প্রভাব এখনও পড়েনি রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) কলেরা হাসপাতালে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় শীতর তীব্রতা বেড়েছে কয়েক দিন। আগামী সপ্তাহে এর প্রভাব পড়তে পারে। আইসিডিডিআর,বির এক কর্মকর্তা বলেন, গত দুই বছরের চেয়ে এবার রোগী অনেক কম। তবে কয়েক দিন ধরে ঢাকাতে কনকনে শীত পড়ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে হয়তো রোগীর চাপ বাড়তে পারে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক ও শিশু বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শুধু নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে গত নভেম্বরে ৩০৯ ও ডিসেম্বরে ৪৩৩ জন রোগী ভর্তি হন। জানুয়ারির পাঁচ দিনে ৮০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ঋতু পরিবর্তনের কারণে শীতকালে ৮০ ভাগ শিশু ভাইরাসজনিত রোগের শিকার হয়। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগী ঢাকা ও আশপাশের এলাকার। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকেও অসংখ্য শিশু ভর্তি হচ্ছ।

শীতে ঠান্ডাজনিত রোগ থেকে বাঁচার প্রতিকার জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সময়ে শিশুদের ভালোভাবে যত্ন নিতে হবে। তাদের যেন ঠান্ডা না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের গরম খাবার খাওয়াতে হবে। আর যদি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পায়, অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।
রমেকে শিশু ওয়ার্ডে তিন গুণ রোগী :রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ওয়ার্ডে তিন গুণ রোগী ভর্তি হওয়ায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্নিষ্টদের। হাসপাতালটির তৃতীয় তলায় ৯ ও ১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ৮০ শয্যার বিপরীতে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ভর্তি ছিল ২৩০ জন। ফলে অনেক শিশুকে হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে ২০ জন কোল্ড ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। বাকিরা শ্বাসকষ্ট, সর্দি-জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। গত ১ ডিসেম্বর থেকে গতকাল ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এ দুটি ওয়ার্ডে শীতজনিত রোগে ভর্তি হওয়া ১১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরীফুল হাসান জানান, এক হাজার শয্যার হাসপাতালে বর্তমানে দুই হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে, যাঁদের অধিকাংশ শীতজনিত রোগী।
রাজশাহীতে রোগী বেড়েছে ৬ থেকে ৮ গুণ :তীব্র শীতে রাজশাহী অঞ্চলে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা অন্তত ৬ থেকে ৮ গুণ বেড়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হুহু করে বেড়েই চলেছে। আগে ঠান্ডাজনিত ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ জন রোগী ভর্তি হতেন। এখন এই শীতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ থেকে ৮০ জন ভর্তি হচ্ছেন। গত ১ থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শুধু শিশু নয়, বিভিন্ন বয়সের মানুষ এ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এতে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও।

দিনাজপুরেও শিশু বেশি আক্রান্ত :দিনাজপুরে শীতের পাশাপাশি বাড়ছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ। এর মধ্যে অধিকাংশই আক্রান্ত হচ্ছেন শীতজনিত নিউমোনিয়া ও সর্দি-জ্বরে। বৃহস্পতিবার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ১৭ জন ভর্তি রোগীর মধ্যে শিশু ছিল ৬টি। শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি ৩৬। এ ছাড়া জেলা শহরের অরবিন্দ শিশু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১৭। এ ছাড়া দুটি হাসপাতালে প্রতিদিনই বহির্বিভাগে শতাধিক রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। তবে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের দুটি ওয়ার্ডে আক্রান্ত রোগীর তুলনায় শয্যাসংখ্যা অপ্রতুল।
হাসপাতালের নবজাতক, শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল কাইয়ুম বলেন, গত মাসে একটি বাচ্চা হাসপাতালে মারা গেছে। প্রতিদিন বহির্বিভাগে শতাধিক রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন।

ফরিদপুরে ঠান্ডাজনিত রোগী কমেছে :টানা চার দিনে শৈত্যপ্রবাহ ও অতিরিক্ত শীতে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগী বাড়ার আশঙ্কা থাকলেও তা হয়নি। চলতি সপ্তাহে ৫০০ শয্যার এই সরকারি হাসপাতালটিতে ঠান্ডাজনিতসহ সব ধরনের রোগী কমেছে। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে গড়ে সেখানে নানা বয়সী ঠান্ডার রোগী ছিলেন ১১০ থেকে ১২০ জন। চলতি সপ্তাহে তা দাঁড়িয়েছে ৭৫ থেকে ৯০ জনে।
[