‘টুয়েলভথ ফেল’ সাদিকুর এখন বিসিএস ক্যাডার, পাশে ছিলেন মিমি
ময়মনসিংহঃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি চর্চিত সিনেমা টুয়েলথ ফেল। মনোজ কুমার শর্মার বাস্তব জীবনের গল্প সম্পর্কে অনুরাগ পাঠকের একটি উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি ওই সিনেমায় দেখানো হয়েছে, মনোজ কুমার কিভাবে চরম দারিদ্রতা কাটিয়ে একজন ভারতীয় পুলিশ সার্ভিস (আইপিএস) অফিসার হয়েছেন। মনোজ টুয়েলভথ ক্লাসে ফেল করেছিলেন।
সিনেমাতে তার পাশে থেকে অনুপ্রেরণা যোগাতে দেখা যায় প্রেমিকা শ্রদ্ধাকে।
সিনেমার মতোই গল্প ৪৩তম বিসিএসএ শিক্ষা ক্যাডার সুপারিশপ্রাপ্ত সাদিকুর রহমানের। যার বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সাখুয়া ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামে। সাদিকুরও এইএসসিতে ফেল করেন। তার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পেছনে অন্যদের সঙ্গে অবদান রয়েছে স্ত্রী আফসানা মিমির।
ছোট বয়স থেকেই মেধাবী ছিলেন সাদিকুর। এসএসসিতে ৪.৮৮ জিপিএ নিয়ে ত্রিশালের সরকারি নজরুল কলেজে ভর্তি হন। এর পর ঘটে ভিন্ন ঘটনা। এইচএসসিতে করে বসেন দুই বিষয়ে ফেল। এতে শিক্ষক বাবার সুনাম নষ্ট হয়েছে। যদিও আগেই বুঝতে পেরেছিলেন পাস করা প্রায় অসম্ভব। তাই ফল প্রকাশের আগেই ব্যগ নিয়ে কম্পানিতে চাকরির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন।
২০১১ সালে আবারও পরীক্ষার আসনে বসেন তিনি। এবার কোনমতে টেনেটুনে পাস বলতে যা বোঝায় তাই সম্বল সাদিকুরের। জিপিএ–২.৯০ নিয়েই খুশি ছিলেন তিনি।
এই রেজাল্ট নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তোলার সুযোগ ছিল না। ভর্তি হয়েছিলেন ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগে। পড়ালেখা চলছিল ভালোই। স্নাতকে তৃতীয় বর্ষে হাতখরচ জোগাতে একটি দোকানের বিক্রয়কর্মীর চাকরি নেন। সেখানে তিন মাস কাজ করে একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন সাদিকুর। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার সময় চাকরি ছাড়তে হয় তাকে।
এর মাঝে ২০১৫ সালে বিয়ে করেন আফসানা মিমিকে। ওই বছরই সিজিপিএ–২.৯৪ নিয়ে স্নাতক শেষ করেন। পরের বছরে সংসারে আসে প্রথম সন্তান। এরই মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে আর্থিক সংকটের কারণে টাকা দেওয়া বন্ধ করেন দেন বাবা। শুরু হয় সাকিকুরের আসল জীবন যুদ্ধ।
স্ত্রী, সন্তান নিয়ে পড়েন বিপদে। তিন হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন একটি স্কুলে। এতে সংসার খরচের কিছুই হতো না। বাধ্য হয়ে নামেন টিউশনিতে। ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত বিভিন্ন বাসা বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াতেন সাদিকুর। এরপর সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্কুল। বাসায় ফিরে আবারও সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পড়াতেন শিক্ষার্থীদের।
নিয়ম করে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নিজের পড়াশোনা। এই যুদ্ধে তাকে সাপোর্ট দিয়েছেন স্ত্রী আফসানা মিমি।
২০১৯ সালের শেষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন সাদিকুর। এতে একটু হলেও সংসারে স্বস্তি ফেরে। ২০২১ সালের শেষ দিকে আমি পুরোদমে বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করেন। ৪১তম বিসিএসে নন–ক্যাডারে ইনস্ট্রাক্টর (বাংলা) পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। আর ২০২৩ সালে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে স্থান পান এইসএসসি ফেল সাদিকুর রহমান।
এই যুদ্ধে পাশে থাকার জন্য স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাদিকুর বলেন, ‘এই পুরো সময়টাতে আমার স্ত্রী আফসানা আক্তার কী অকুণ্ঠ সমর্থন, সহায়তা যে আমাকে দিয়েছে, সে কথা বলে বোঝানো যাবে না।’ একই সঙ্গে বড় বোন শারফুন্নাহার বিউটির কথা স্বরণ করেন সাদিকুর।
তিনি বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। এখন আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন। আমার বাবা-মা, স্ত্রী ও দুটি সন্তান নিয়ে দেশের শিক্ষাখাতে অবদান রাখতে চাই।’
টুয়েলভথ ফেল সিনেমা প্রসঙ্গে সাদিকুর বলেন, ‘সিনেমাটি আমি দেখেছি। অনেক কিছুই আমার জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। আমিও তো উচ্চমাধ্যমিকে ফেল করেছিলাম। যদিও তেমন মেধাবী নই, কিন্তু আমার জীবনের গল্পও কখনো কখনো সিনেমার মতোই মনে হয়েছে।’
সাদিকুরের স্ত্রী আফসানা মিমি বলেন, ‘সাদিকুর অনেক পরিশ্রম করেছে। আমি চেষ্টা করেছি তাই এই সময়ে শুধু সাহস যোগাতে। পাশে থেকে দেখেছি তার যুদ্ধ। বাবা-মায়ের দোয়ায় সে এই সাফল্য অর্জন করেছে।’
সাদিকুরের বাবা শওকত আলী মাস্টার বলেন, ‘আমার দুটি ছেলে বড় ছেলে বাকপ্রতিবন্ধী, ছোট ছেলে সাদিকুর। তাকে নিয়েই আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। মনে করেছিলাম সে আমার স্বপ্ন পূরন করতে পারবে না। বাবার সাথে অভিমান করে সে যে সাফল্য অর্জন করেছে আমি অনেক গর্ববোধ করি।’ দেশ রূপান্তর
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/০১/২০২৪