জ্ঞানের ফেরিওয়ালারা এখন ভ্যানওয়ালা
।। ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন।।
একজন মহান শিক্ষকের কাজ একজন স্থপতি বা শিল্পীর কাজের চেয়েও অধিক তাৎপর্যমন্ডিত। কারণ একজন শিক্ষকের কাছে তৈরি হচ্ছে শিল্পী, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, কবি, সাহিত্যিক, কৃষিবিদসহ দেশ পরিচালনার মহান মানুষ। এই হিসাবে একজন শিক্ষকের মূল্য শুধু তার এই সৃষ্টির সম্মান।
শিক্ষককে তাই শিক্ষাবোদ্ধারা আখ্যায়িত করেছেন, ‘জাতির মহান কান্ডারী হিসাবে ।’ তাই পেশা হিসাবে শিক্ষাকে অবশ্যই গুরু দায়িত্ব, জাতীয় দায়িত্ব হিসাবে মনে করতে হবে। এখানে ফাঁকির কোন সুযোগ বা স্থান নাই। আছে শুধু সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় কাজ করার মহান দায়িত্ববোধ। আর এই বিষয়টি আমাদের মধ্য থেকে যারা এই পেশায় এসেছেন তাদের উপলব্ধি করা দরকার। এই উপলব্ধি নাই বলে আমাদের শিক্ষার এমন আত্মসমর্পন।
শিক্ষাবিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞরা শুধু বছর বছর শিক্ষক্রম পরিবর্তনের কাজে মনোযোগি হয়েছেন। কিন্তু তারা কখনও উপলব্ধি করেনি যে, একজন শিক্ষক মানে একটি শিক্ষাব্যবস্থা।
শিক্ষক যদি শিক্ষাব্যবস্থা হন তাহলে জাতি হিসাবে আমরা এগুতে পারব। করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটি শুরু ১৭ মার্চ ২০২০ সেই হিসেবে ১ বছর ৩ মাসের অধিক কাল। এই সময় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই বলেন কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়েছে! বিষয়টি সঠিক নয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ত বন্ধ হয়নি কিন্তু শিক্ষকদের পাওনা দিতে পরেছেন না।
বহু এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের খন্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন যারা এই আয় দিয়েই সংসার চালাতেন তারা আজ কি করছেন ? লকডাউন নামক অর্ধেক খোলা অর্ধেক খোলার যে কাহিনী!! এই কাহিনী শিক্ষকদের মত কত মানুষকে পথে বসিয়েছে সরকার বাবু খবর নিয়েছেন? নেননি। নেয়ার সময় বা কোথায়। যে দেশে করোনার কারণে না খেয়ে পথে বসছেন অনেকেই!!
সেই দেশের সংসদে এখনও রাষ্ট্রপ্রধান বিরোধীদলের নামের বাহাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সেই দেশে অন্য খবর নেয়ার সুযোগ বা কতটুকুন ??
শিক্ষকরা যুগে যুগে অভুক্ত ছিলেন। অভুক্ত রেখে আমরা শিক্ষকদের হাতে গড়ে তুলতে চাইছি সমৃদ্ধ জাতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে দুই ধরনের শিক্ষক থাকেন একধরনের এমপিওভুক্ত। যাদের ভাগ্যবান হিসেবেই অবিহিত করা হয়। এই ভাগ্যবান শিক্ষকরা তাদের সকল বেতন ভাতা এমনকি তিনটি উৎসব ভাতাও পেয়েছেন বিগত বছরে। আর আয়েশি জীবন তো আছেই।
তবে তাদেরও অনেকের অবস্থা ভালো নয় যাদের অধিক খরচ। কারণ তাদের প্রাইভেট বন্ধ হয়ে গেছে। আরেক ধরনের হলেন নন-এমপিও যাদের হতভাগাই বলা চলে। এই হতভাগারা গত এক বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে কোন বেতন পাননি। তাদের কথা একবার ভাবুন তো। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে বেসরকারি বা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের কথা তো আন্দাজ করা যায়। তাদের অবস্থা এখন শেষ পর্যায়ে।
যশোর উপশহর মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক শরিফুল ইসলাম। ২০১৫ সাল থেকে তিনি এই কলেজের বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক। কিন্তু তিনি নন-এমপিও। যার ফলে কলেজ থেকে সামান্য বেতন পেতেন যা দিয়ে জোড়াতালির সংসার। গত ৫ মাস ধরে তিনি কলেজ থেকে সেই বেতনও পান না।
এতদিন লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টি গোপন রেখে কোনভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন। অবশেষে নিরুপায় হয়ে তিনি ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এই স্ট্যাটাস পড়ে ক্ষমতাসীনদের কতটা নিজেকে দেখার সুযোগ হবে জানি না-তবে বিবেকবান যেকোন মানুষের মন ও চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন কথা বলেন, একটি বারও এই শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করতেও শুনিনি। কেন এই নিরবতা? কেন এমন তাচ্ছিল্য? বড় অসহায় মনে হয়।
শরিফুল ইসলাম তার নিজের নয় শুধু-সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি এই স্ট্যাটাসের মাধ্যমে পুরো শিক্ষক সমাজের যে অবস্থা তা তুলে এনেছেন। করোনা শুধু শিক্ষক নন কতশত মানুষের দিনের রোজগার এভাবে পথে বসিয়েছে সেই খবর রাখেন কিনা সরকার তা জানা নেই। কিন্তু প্রতিদিনকার চিত্র হল লুটপাট চলছে। সেই ঐক্য ও খবর তাদের ঠিকই আছে। এই এক মহা উৎসব।
হরিলুটের এই শহরে শিক্ষক সমাজের এমন অবস্থার খবর নেয়ার সময় কারো নেই? বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বেকার বা অর্ধ-বেকার। বেকার বা অর্ধ-বেকারের এই শহরে শরিফুলরা আর পারছে না !! তারা অসহায়। এমন অবস্থার মধ্যে কি হাস্যকর!! অর্থমন্ত্রী গবেষকরা বেকারের যে চিত্র তুলে এনছেন তাদের নাম ঠিকানা চেয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী একজন শরিফুল তার নাম ঠিকানা আপনাকে দিলেন!! খোঁজ নেয়ার সময় হয়েছে আপনার? হয়নি। নিলে তো তাবদ দুনিয়ায় খবর হয়ে যেত। আপনার এলাকার এই জাতীয় শরিফুলদের তালিকাটিও কি আমাদের বা গবেষকদের করে দিতে হবে? তাদের অবস্থা কি ? একটু সময় করে দেখে আসবেন?
দীর্ঘ দিন বিশেষত করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে ধারাবাহিক নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া ও নিজে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে আমি নিজ চোখে দেখেছি শিক্ষকরা কেমন আছেন!! মোটেই ভাল নেই।
তারা সত্যিই ভালো নেই। একজন শিক্ষক বেতন পান না। যার একমাত্র আয় ছিল এই বেতনটাই। ভাবুন তো কিভাবে চলে? ঘরভাড়া দিতে পারেন না, সংসার চলে না। আহ কি কঠিন সময়। অপরদিকে কিন্ডারগার্টেন গুলো ভাড়া বাসাতে গড়ে উঠেছে অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষাথীরা বেতন দেন না, শিক্ষকদেরও অবস্থাও ভাল না।
এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে দেশে প্রায় ৬৫ হজোরে বেশি। ১২ লক্ষের অধিক পরিবারের এখানে জীবন জীবিকা নির্ভর করে। এখানকার শিক্ষকরা কচু বিক্রেতা, রিক্সাচালক, ভ্যানের ড্রাইভার, চা বিক্রেতা থেকে এমন কোন পেশা নাই তারা বেছে নেননি। এমন অবস্থা একদিনে তৈরী হয়নি।
জ্ঞানের ফেরিওয়ালারা এখন ভ্যানওয়ালা। একসময় সামান্য বেতনে জ্ঞানের ফেরি করে বেড়াতেন এখন তারা ভ্যানে তরকারি, মাছ, ডিম, সবজি ফেরি করে বেড়ান। এই হল উন্নয়ন। সংবাদ মাধ্যম বিশেষত বাংলাদেশ টেলিভিশন খুললে মনে হয় ইউরোপ বা আমেরিকার মত কোন বিরাট রাষ্ট্রের নাগরিক আমরা। অথচ যারা জাতিকে তৈরী করেন তাদের অবস্থা এমন! যারা এইসব করেন একটু লজ্জাসরমও তো থাকা চাই।
জনগনের টাকায় জনগনের সাথে তামাশা। যা খুশি করেন! কিন্তু এই শরিফুলদের খবরটাতো নিবেন। তাদের মুখে একবেলার খাবার তো দিবেন। ৩৩৩ নম্বরে খাবারের জন্য ১দিনে ১৯ লক্ষ ফোন এসেছে। গতকালের খবর। এই হল উন্নয়ন। এই হল সুবাতাস। অর্থমন্ত্রী তালিকার পর তালিকা দিলেও শেষ হবে না। তারপরও তালিকা চাইবেন। বলবেন এইগুলো গুজব।
কর্মহীন উপার্জনহীন পথে বসা এ শিক্ষকদের খবর না নেয়ার মধ্য দিয়ে একটি জাতি কতটা পেছনে পড়ছে সেই বিষয়টি ভাবনায় আনবার মত সময় করে নিবেন প্লিজ। বহুদিন হয়ত অপেক্ষা করতে হবে না, রুচিশীল জ্ঞানে কমে সৌন্দর্যের এই মানুষ গুলো শিক্ষকতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। আর যোগ্য ও অভিজ্ঞ যেসকল সন্মানিত শিক্ষক এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন তারাও আর পূর্বের প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসবে না। একটু সন্মান নিয়ে জীবন পরিচালনার জন্য শিক্ষকতাকে পেশা ও নেশা হিসাবে যারা গ্রহণ করেছেন তাদের এমন অবস্থা হলে দেশ কোন দিকে যাবে একটু ভেবেছেন। তবে যাদের সামনে ক্ষমতার আয়না পড়ে আছে তারা তো এইসব দেখবেন না, দেখার সময়ও হবে না।
ক্ষমতা ফুরালে হয়ত এই আয়না যাবে তখন অনেক কিছু দেখবেন। দেখার অপেক্ষায় থাকবেন। তবে অভুক্ত শিক্ষকদের পাশে থাকার ও তাদের পক্ষে কথা বলার মধ্য দিয়ে বরং দেশকে রক্ষা করা যাবে এটাই বুঝবার সময় হয়েছে।আসুন একটু বুঝি। একটু আয়নার পেছনের খবরটা নিই-
লেখক : শিক্ষবিদ-নজরুল গবেষক।