‘জীবনযুদ্ধে আর পারছি না’
মো. আল-আমিন।।
মিলন। আগারগাঁওয়ের একটি বেসরকারি স্কুলের দারোয়ান। বেতন ১৪ হাজার টাকা। স্কুল শেষে একটি দোকানে কাজ করেন। সেখান থেকে পান ৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ১৯ হাজার টাকা দিয়ে চালাতে হয় সংসার নামক পাহাড়। গত কয়েক বছর ধরে নিত্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়লেও আয় বাড়েনি তার। রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় এক রুম ভাড়া নিয়ে তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন। রুম ভাড়া প্রতিমাসে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। অন্যদিকে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ের বেতন ও টিউশনিসহ মাসের খরচ প্রায় ৪ হাজার টাকা।
জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে তার।
মিলন বলেন, আর পারছি না। স্কুল থেকে আমাকে প্রতি মাসে বেতন দেয়া হয় ১৪ হাজার টাকা। স্কুল ছুটির পর একটি দোকানে কাজ করি। সেখান থেকে ৫ হাজার টাকা পাই। এই আয় দিয়ে সংসার চালানো দায়। উপায় নেই। খেয়ে না খেয়ে পার করতে হচ্ছে দিন। কষ্টটা মেনে নিতেই হবে। তিনি বলেন, আগে মেয়েকে মাঝে মধ্যেই দুধ ও ডিম খাওয়াতাম। এখন সেগুলোর চেহারা দেখাই বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া মেয়ের জন্য মাঝে মাঝে ফল কিনতাম, সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এক কথায় বর্তমানে পুষ্টির চিন্তা করি না, খেয়ে বেঁচে থাকার চিন্তা করি। তবে এভাবে জিনিসের দাম বাড়তে থাকলে কতোদিন চলতে পারবো সেটাই ভাবি।
আসিফ আলী। শ্যামলী এলাকার ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রাইভেটকার চালান। বেতন পান ১৮ হাজার টাকা। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পেরে সংসার খরচ কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ছেলের পড়ার খরচ কমাতে গৃহশিক্ষক বাদ দিয়েছেন। সন্তানের জন্য বাসায় প্রতিদিন দুধ নিতেন, এখন সেটিও বন্ধ। আসিফ আলী বলেন, বেতনের অধিকাংশ টাকায় বাসা ভাড়া বাবদ খরচ করতে হয়। সংসারে টানাটানি। অতিরিক্ত খরচ তো কখনো করি না। তারপরও খরচ কমাতে হচ্ছে। প্রতি মাসে তিন লিটার তেল লাগতো। এখন এক থেকে দেড় লিটারে সারতে হচ্ছে। আগে যেখানে দুই পদের তরকারি খেতাম। এখন সেখানে এক পদ। কখনো শুধু ডাল। কখনো বা শুধু শাক। আগে যেখানে সপ্তাহে একদিন মাংস খাওয়া হতো, এখন সেখানে মাসে এক থেকে দুইবার খাচ্ছি। এ ছাড়া মাছ খাওয়াও কমাতে হয়েছে। তেলাপিয়া-পাঙ্গাশের দামও অনেক বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, আগে বাচ্চার জন্য মাঝে মাঝে ফল কিনে আনতাম, সেটিও এখন পারছি না। বাচ্চার প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করতে হয়েছে।
রাইড শেয়ারিং করে প্রতি মাসে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো আয় করেন রিপন। স্ত্রী ও মা’কে নিয়ে থাকেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায়। রিপন বলেন, মাসে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা আয় করি। এই টাকা দিয়েই অনেক কষ্টে সংসার চালাতে হচ্ছে। মানিয়ে চলা ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। এর আগে তিনি বেসরকারি একটি চাকরি করতেন। সেখানে তার বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চাকরি ছেড়ে রাইড শেয়ারিং শুরু করেন। মার্চ মাসে মা ও স্ত্রীকে ঢাকায় আনেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে মা ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় একসঙ্গে আর থাকা হচ্ছে না রিপনের। আগামী মাসে মা ও স্ত্রীকে আবারো গ্রামে পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তা করছেন। বলেন, ভেবেছিলাম মা ও স্ত্রীকে কাছে রাখতে। কিন্তু পারছি না। চিন্তা করছি আগামী মাসেই তাদের গ্রামে পাঠিয়ে দেবো। এরপর আমি মেসে থাকবো। তিনি বলেন, এখন খাবার তালিকায় সবজি ছাড়া কিছু জুটছে না। মাসে সর্বোচ্চ তিন থেকে চারবার মাছ খাওয়া হয়।
সিএনজি চালক তুহিন ইসলামের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা। তার স্ত্রী-সন্তান থাকেন গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটে। তিনি থাকেন কল্যাণপুরের একটি ভবনের দারোয়ানের কক্ষে সিট ভাগাভাগি করে। জিনিসের অস্বাভাবিক দর বেশ ভোগাচ্ছে তাকে। খরচ কমাতে প্রিয় খাবার বর্জন করেছেন। ডিম ও শাক-সবজি খেয়েই দিন পার করছেন। তবুও প্রতি মাসে স্ত্রীকে টাকা পাঠানোর সময় লাগছে টানাটানি। কারণ, তিনি যে টাকা পাঠান, তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার স্ত্রীর। তুহিন বলেন, তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। এর মধ্যে বড় ছেলে ও মেয়ে পড়াশোনা করে। তাদের পড়াশোনার খরচ মেটাতেই অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়। আমার স্ত্রী সেলাইয়ের কাজ করে সংসার খরচ কিছুটা সামাল দিচ্ছে। তবে সন্তানদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে পারছি না। সন্তানদের নিয়মিত পোশাক দিতে পারছি না। আগে দুপুরে মাছ দিয়ে ভাত খেতাম এখন ডাল দিয়ে খাই। পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল, সেটিও ছেড়ে দিয়েছি।
ঢাকায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকারও কম বেতনে জীবন চালাতে হচ্ছে অধিকাংশ মানুষকে। কম খেয়ে ও পরে মানিয়ে নিচ্ছে এসব মানুষ।