জাবিতে সেশনজটে ১৩০০০ শিক্ষার্থী
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের (৪৫তম ব্যাচ) পাঠদান শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের মার্চে। সাত বছর পার হয়েছে। এখনো পড়াশোনার পাট চুকাতে পারেননি এই ব্যাচের কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, এই ৪৫তম ব্যাচের স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। এখন অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার থেকে প্রত্যেকটি ব্যাচই পিছিয়ে রয়েছে। বিভাগগুলোতে রয়েছে ছয় থেকে সাতটি ব্যাচ। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব কটি বিভাগের শিক্ষার্থীরাই সেশনজটে পড়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩৪টি বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউটে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে শিক্ষার্থী রয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার। এর মধ্যে ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেনসিং অ্যান্ড জিআইএসে শুধু স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে। এই ইনস্টিটিউট ছাড়া বাকি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে এখন এক থেকে দুই বছরের সেশনজট রয়েছে।
সেশনজটের জন্য করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকাকে দায়ী করছে প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গত দেড় বছরে নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, ভিন্ন কথা। তাদের মতে, করোনাভাইরাসের পর সেই আগের মতোই গা-ছাড়া শিক্ষকরা। অনেকেই সময়মতো পাঠদান ও পরীক্ষা নেন না। শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ উইকেন্ড কোর্স ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোতে ব্যস্ত থাকেন বলেও অভিযোগ তাদের।
করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে পাঠদান চালুর সময় সেশনজট নিরসনে শিক্ষাবর্ষ দ্রুত শেষ করার অঙ্গীকার করেছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম। তবে উপাচার্যের এ ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি।
২০২১ সালের জুনে করোনাভাইরাস মহামারীর সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়। তখন অধিকাংশ বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের স্নাতক চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়েছিল। প্রায় দুই বছর হতে চলল এখনো কয়েকটি বিভাগে ওই ব্যাচের স্নাতকোত্তর শেষ হয়নি।
গত দুই বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা ছাত্র সংগঠনের বিরোধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এক দিনের জন্যও বন্ধ ছিল না। ছাত্র সংগঠনগুলোর বিভিন্ন আন্দোলনের কারণে শ্রেণিকার্যক্রমও ব্যাহত হয়নি। তবু শিক্ষার জট ছাড়ার বদলে পাকিয়েছে। এত দিনে ৪৬তম ব্যাচের স্নাতকোত্তর সম্পন্ন হওয়ার কথা। তবে সম্প্রতি ৪৫তম ব্যাচের কয়েকটি বিভাগের স্নাতকোত্তর শেষ হয়েছে। পরীক্ষা দিয়ে এখনো ফল প্রকাশের অপেক্ষায় আছে কয়েকটি বিভাগ। আর ৪৬তম ব্যাচের কোনো বিভাগেরই স্নাতকোত্তর হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফার্মেসি ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ফলাফল প্রকাশ করতেই লেগে গেছে সাত মাস। ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়া, নির্ধারিত সময়ে পাঠদান ও পরীক্ষা শেষ না করার মতো ঘটনাগুলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই পরিচিত। নির্ধারিত সময়ে শিক্ষাজীবন শেষ না হওয়ায় হতাশায় ভুগছেন অনেক শিক্ষার্থী। পরিবারকে সহায়তা করতে না পারার কষ্টও আছে তাদের মধ্যে। সেশনজটের জন্য শিক্ষকদের গাফিলতি ও অবহেলাকে বড় করে দেখছেন শিক্ষার্থীরা।
নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়া, পরীক্ষার ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতাকে সেশনজটের প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছেন তারা। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পরিকল্পনা ও নজরদারির অভাবও রয়েছে।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জহির ফয়সাল বলেন, ‘সেশনজট নিরসন করতে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় না। শিক্ষকরা ঠিকভাবে ক্লাস-পরীক্ষা নেন না। এ কারণেই আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।’
উইকেন্ড কোর্স শেষ হয় নির্ধারিত সময়ে : বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৬টি বিভাগে ১৮টি বাণিজ্যিক কোর্স চালু রয়েছে। যাকে কাগজে-কলমে বলা হচ্ছে উইকেন্ড কোর্স। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার এই কোর্সের শ্রেণিকার্যক্রম চলে। এক থেকে দুই বছরের এই কোর্সগুলোতে প্রত্যেক বছরে দুই থেকে তিনটি আলাদা সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভাগগুলোর উইকেন্ড কোর্স নির্ধারিত সময়েই শেষ হয়।
নিয়মিত শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, ‘তাহলে চার বছরের স্নাতক চার বছরে এবং এক বছরের স্নাতকোত্তর কেন এক বছরে নেওয়া সম্ভব হয় না?’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, উইকেন্ড কিংবা সান্ধ্যকালীনের মতো কোর্সের মূলত উদ্দেশ্য থাকে বাণিজ্যিক। এখানে কী পড়ানো হলো বা কতটুকু পড়ানো হলো সেটি মুখ্য নয়। তবে এই কোর্সে সময় দিতে গিয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলেও মনে করেন তারা।
তবে ব্যক্তিগত আদর্শের তাড়নায় শিক্ষকদের শিক্ষাদানে উদ্যোগী হওয়ার কথা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ। তিনি বলেন, ‘শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস পরীক্ষা না নিলে তাদের বাধ্য করার বিধান আসলে নেই। শিক্ষকতার এই পেশায় শিক্ষকদের ব্যক্তিগতভাবে আদর্শের জায়গা ঠিক রাখা উচিত, দায়িত্বে জায়গায় যথাযথভাবে কাজ করা উচিত।’
শুরুর ‘উপহার’ সেশনজট : বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৩১ জানুয়ারি ৫১তম ব্যাচের (২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ) পাঠদান শুরু হয়। অথচ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। অন্য বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়েই জাহাঙ্গীরনগরের আগে ক্লাস শুরু হয়। এর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রথমত, অন্যদের তুলনায় দেরিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া ও ভর্তি প্রক্রিয়ায় ধীরগতি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আবাসিকতা নিশ্চিতে পাঠদান শুরু করতে দেরি করা। তবে প্রতি বছর আবাসন নিশ্চিতের কথা বলে দেরিতে পাঠদান শুরু করা হলেও কোনোবারই শিক্ষার্থীদের আসন দিতে পারেনি প্রশাসন। এবারও এসব কারণেই জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি পরীক্ষার ছয় মাস পর পাঠদান শুরু হয়েছে।
অনুমতি ছাড়াই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই অনুমতি ছাড়াই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে ৩১ জন শিক্ষক অনুমতি নিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তবে দেশ রূপান্তর খোঁজ নিয়ে যে তথ্য পেয়েছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি অনুষদ থেকেই এর বেশি শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। গেল বছরের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের বিশেষ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অনুমতি ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি শৃঙ্খলার পরিপন্থী।
ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একজন শিক্ষক একসঙ্গে দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সর্বোচ্চ ৬ ক্রেডিট) শিক্ষকতা করতে পারবেন। আবার উইকেন্ড কোর্সে পাঠদানকারী শিক্ষকরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সর্বোচ্চ ৩ ক্রেডিট) পড়াতে পারবেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করতে পারবেন না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বলেন, ‘সেশনজট নিরসনে বিভাগগুলোতে সময়মতো এবং দ্রুততার সঙ্গে পাঠদান শেষ করে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। পরীক্ষার ফল প্রকাশে যেন বিলম্ব না হয় সেদিকেও দৃষ্টি রয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে মূলত জাতীয়ভাবে একটু জট রয়েছে। কিছুদিন আগে একটি ব্যাচের ক্লাস শুরু হলো। আবার সামনে আরেকটি ব্যাচ আসবে। তবে আমরা সেশনজট কমাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। এতে কারও গাফিলতি থাকলে সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৩/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়