ছেলে সুপার, বাবা সভাপতি: নেপথ্যে নিয়োগ বাণিজ্য
সাতক্ষীরাঃ জেলার আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের খাজরা হাকিমিয়া দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবু রায়হানের বিরুদ্ধে নিয়মবহির্ভূতভাবে ম্যানেজিং কমিটি গঠন এবং কমিটি দ্বারা তড়িঘড়ি করে জনবল নিয়োগের পাঁয়তারা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শিক্ষক ও স্থানীয়দের অভিযোগ ভারপ্রাপ্ত সুপার তার স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজের বাবাকে সভাপতি ও স্ত্রীসহ স্বজনদের কমিটির তিনটি পদে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খাজরা হাকিমিয়া দাখিল মাদ্রাসাটি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠাতা করেন হাকিমিয়া নামের এক ব্যক্তি। পরে মাদ্রাসাটি ১৯৯৬ সালে এমপিওভুক্ত হয়। বর্তমানে মাদ্রাসাটিতে মাত্র ১৮০ জনের মতো শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে ১৩ জন।
সরেজমিনে মাদ্রাসাটিতে গিয়ে দেখা যায়, মাদ্রাসাটি ৩৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো জরাজীর্ণ, নেই কোনো সাইনবোর্ড। মাদ্রাসার পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে তিনটি টিনশেট ঘর রয়েছে। দক্ষিণ পাশের টিনশেটটি মাদ্রাসার অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করছেন। বর্তমানে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ছুটি থাকলেও মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবু রায়হানকে পাওয়া যায়নি। জানা যায়, সুপার দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকেও নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। সেখানে তার স্ত্রী মাদ্রাসাটির মহিলা শিক্ষক নাছিমা খাতুন স্বামী-শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়ে তিনিও ঠিকমতো উপস্থিত থাকেন না বলেও জানা যায়।
সম্প্রতি নিয়মবহির্ভূতভাবে ম্যানেজিং কমিটি গঠনসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন স্থানীয় রিপন হোসেনসহ কয়েকজন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান কমিটির সভাপতি মাওলানা রুহুল আমিন সুপারের দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডের কারণে তার নামে একাধিক নাশকতা মামলা চলমান। মাদ্রাসার সুপার ও সহসুপার না থাকায় নীতিমালা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সিনিয়র শিক্ষক। কিন্তু সভাপতি সেই নীতিমালা অনুসরণ না করে তার ছেলে সাধারণ শিক্ষক মো. আবু রায়হানকে ভারপ্রাপ্ত সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করাচ্ছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, সভাপতি নিজের প্রভাব খাটিয়ে মাদ্রাসার সুপার, সহসুপার পদ খালি থাকা সত্ত্বেও সেখানে নিয়োগ না দিয়ে তার ছেলেকে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সুপার বহাল রেখেছেন যেটি সম্পূর্ণ অবৈধ। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, শিক্ষকদের মধ্যে টিআর দুজন পুরুষ সদস্য ও একজন টিআর মহিলা সদস্য কমিটিতে থাকার কথা থাকলেও দুর্নীতিবাজ সভাপতি দুজন মহিলা সদস্য একজন পুরুষ সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেছেন। টিআর সদস্যদের মধ্যে নিজ পুত্র আবু রায়হান ও পুত্রবধূ নাছিমা খাতুন সদস্য এবং নিকটতম আত্মীয় শহিদুল ইসলাম, মো. হাফিজুল ও রুপবান বিবিকে অভিভাবক সদস্যদের পদে রাখা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটিতে তাদের কারও ছেলেমেয়ে লেখাপড়া না করেও তাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেছেন পিতা ও পুত্র।
খাজরা হাকিমিয়া দাখিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ী শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভারপ্রাপ্ত সুপার আবু রায়হান আমাদের ছাত্র ছিল, ওর বাবা বর্তমান সভাপতি মাদ্রাসার সুপার থাকাকালে আইসিটি শিক্ষক অস্থায়ী হিসেবে কর্মরত ছিল, সেখান থেকে স্থায়ী হয়ে বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সুপার কীভাবে হলো আমাদের জানা নেই।
শিক্ষক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকরা যে টিউশন ফি পায় এটা সরাসরি প্রতিষ্ঠান প্রধানের অ্যাকাউন্টে চলে আসে। আমরা যখন টিউশন ফি’র কথা বলি, তখন ভারপ্রাপ্ত সুপার বলে অফিসের অন্যান্য কাজে লেগে গেছে, টিউশন ফির টাকা শিক্ষকদের পাওনা, কিন্তু সে টাকা আমরা পাই না।
মৌলভী শিক্ষক মো. মোশারফ হোসেন বলেন, এই মাদ্রাসায় ২০২২ সালে যে কমিটি হয়েছে এ কমিটির সম্পর্কে আমাদের কোনো কিছু জানায়নি এবং আমরা কিছু জানি না, আমরা জানি যে, সব সময় টিআর শিক্ষক নির্বাচিত হয় শিক্ষকদের আলোচনার মাধ্যমে, কিন্তু এখানে কোনো আলোচনা হয়নি, এমনিই জানতে পারলাম যে নির্বাচন হয়ে গেছে। টিআর হয়েছে ইবতেদায়ী শাখার দুজন মহিলা, একজন হলো ভারপ্রাপ্ত সুপারের স্ত্রী, আর একজন তার আত্মীয়। দাখিল শাখার যারা সিনিয়র শিক্ষক আছে তাদের কাউকে রাখা হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয়েছেন ভারপ্রাপ্ত সুপারের আব্বা, এখানে সবকিছুই পরিবারতন্ত্রেই চলছে।
খাজরা হাকিমিয়া দাখিল মাদ্রাসার জমিদাতা ও সাবেক সভাপতি মো. তোফাজ্জেল হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, আমরা ১৯৮৫ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করি, যতদিন পর্যন্ত সরকারি বেতন-ভাতা চালু হয়নি, ততদিন আমার টাকায় মাদ্রাসা চলে এসেছে। দীর্ঘদিন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি, যেখান থেকে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হয়েছে সেখান থেকে কেউ আমার খোঁজ-খবর নেয় না, আমাকে আর কেউ মূল্যায়নও করে না। ভারপ্রাপ্ত সুপারের মা বাদে আর সবাই এখানে চাকরি করে। বাবা-ছেলে মিলে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করেছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমি প্রতিষ্ঠানটির জমিদাতা, কিন্তু বর্তমান কমিটির বিষয়ে আমাকে কিছু জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাজরা হাকিমিয়া দাখিল মাদ্রাসার সাবেক সুপার ও বর্তমান সভাপতি মাওলানা রুহুল আমিন বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না, কমিটি বিধি মোতাবেক করা হয়েছে।
তবে ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবু রায়হানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তার ফোন রিসিভ হয়নি। কালবেলা
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৭/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়