চলে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
নিউজ ডেস্ক।।
৪০ দিন হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকার পর প্রয়াত হয়েছেন ওপার বাংলার বর্ষিয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দীপাবলি উৎসবের মধ্যেই চলে গেলেন তিনি।
তিনি পছন্দ করতেন না উৎসবের পর বিসর্জনের দিন। ছোটবেলায় জলঙ্গী নদীর পাড়ে বিসর্জনের কোলাকুলির মাঝেও বিসর্জিত প্রতিমার মুখে অনিবার্য ‘শেষ’ সবকিছু থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগিয়ে রেখেছিল তার মনে। বিসর্জনের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন তিনি, ‘আমার মধ্যে বিসর্জনের অন্ধকার রয়েছে। যেটা এক আততায়ীর মতো বসে আছে। সে আর আমাকে ধরতে পারবে না। অতএব পালাও। দে ছুট, দে ছুট!’
পৃথিবী থেকে সরে যাওয়ার আগে প্রশ্ন রেখেছিলেন নিজের কাছে, ‘এই যে এত কিছু করলে। এ সব কেন? তুমি পাশ দিয়ে গেলে ওই যে ছেলেগুলো আজও চিৎকার করে, দ্যাখ-দ্যাখ, স-উ-মি-ত্র! স-উ-মি-ত্র যাচ্ছে, তার জন্য তো নয়। এটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য ছিল না? আমি তো চেয়েছিলাম, আমি হেঁটে গেলে লোকে বলবে, ওই যে যাচ্ছে! ওর মতো অভিনয় কেউ করতে পারে না। আদারওয়াইজ এই জীবনের কী মানে? মানুষের কী উপকার করতে পারলাম? তখন নিজেকে বোঝাই, অভিনয়ের মাধ্যমে যেটুকু আনন্দ বিতরণ করতে পেরেছি, সেটাও তো এক অর্থে মানুষের সেবা। সেটাও তো একটা উপকার।’
নাহ্, উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি তিনি। অন্যান্য তারকার মতো কমার্শিয়াল ছবিতে দাপিয়ে কাজ করেছেন এমনও নয়। তবু বেলাশেষে তিনি সৌমিত্র! তার একমাত্র সম্পদ ‘অ্যাকাডেমিক ইনটেলিজেন্স’। অভিনয়ে বুদ্ধির সংযত ঝলক। ওই মগজ দিয়েই শিখেছিলেন তিনি সিনেমার লাগসই মাপ।
ক্যামেরার সামনে অবিচল থাকার বোধ। বাংলার আর কোন অভিনেতা স্বাভাবিক আলাপে ‘প্রতিস্পর্ধী’, ‘মনোগঠন’, ‘দার্ঢ্য’, ‘দ্বিত্ব’ বা ‘বিদ্যাবত্তা’র মতো শব্দ ব্যবহার করেন? কার বাচনভঙ্গিতে থাকে গভীর অধ্যয়নের ছায়া? কখনও তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ আবার কখনও সত্যজিৎ রায়ের প্রদোষচন্দ্র মিত্র। ‘ময়ূরবাহন’ থেকে ‘ময়ূরাক্ষী’। ‘ক্ষিদ্দা’ থেকে ‘উদয়ন পণ্ডিত’। বাঙালি তাকে ঘিরে সব আশা দু’হাত ভরে মিটিয়েছে।
সৌমিত্র একই সঙ্গে ছিলেন অভিনেতা, নট ও নাট্যকার, বাচিক শিল্পী এবং কবি। তার চিত্রশিল্পী পরিচয় অনেককে মুগ্ধ করলেও তিনি নিজে তার ছবি আঁকা নিয়ে বরাবর সংশয়ী ছিলেন। একসময় ‘এক্ষণ’ সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন সৌমিত্র। সেই কাজে তার পাশে ছিলেন তার ‘মানসপিতা’ সত্যজিৎ।
তবে অভিনয়ই তার রক্তে, স্মৃতিতে, জীবনের রোজনামচায়। তিনি বলেছিলেন, ‘সেই শৈশবকাল থেকে আজ অবধি অভিনয় ছাড়া অন্যকিছু ভাবিনি। অভিনয়টা সবসময় বুকের মধ্যে লালন করতাম। অন্য যা কিছু করেছি সবই ছিল ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ।’
ছোটবেলায় দীর্ঘ ৬৩ দিন টাইফয়েডে ভুগে হাঁটতে ভুলে গিয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর নতুন করে হাঁটা শিখতে হয়েছিল। ‘আমাকে লোকে নেবে তো?’ এই ভীতি, শঙ্কা এবং প্রশ্ন ‘অপুর সংসার’-এ আবির্ভাব পর্যন্ত তাকে তাড়া করেছে। একজন পারফর্মার হিসাবে ছটফটিয়ে উঠত তার মন। তাই সেলুলয়েডের পাশাপাশিই মঞ্চে, সাহিত্যে, গানে নিজের অন্তরের ক্ষুধা মিটিয়ে ফিরেছেন তিনি।
কলকাতার মির্জাপুর স্ট্রিটে জন্ম ১৯৩৫ সালে। ছেলেবেলা কেটেছিল ‘ডি এল রায়ের শহর’ কৃষ্ণনগরে। মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়। গৃহবধূ। বাবা মোহিত চট্টোপাধ্যায়। পেশা ওকালতি। নেশা শখের থিয়েটারে অভিনয়। নদিয়া থেকে হাওড়া। হাওড়া জেলা স্কুলে পড়াশোনা। তারপর সিটি কলেজ থেকে বাংলার স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। হাইস্কুল থেকেই অভিনয় শুরু। সত্যজিতের সঙ্গে তার মানসপুত্রের আলাপ ১৯৫৬ সালে। যার পরিচালনায় মোট ১৪টি ছবিতে কাজ করেছেন সৌমিত্র।
সৌমিত্রের এই মনন, নিরন্তর অতৃপ্তিই তাকে সত্যজিতের সারাজীবনের সঙ্গী করে তুলেছিল। ‘সৌমিত্র নিজে থেকেই বুঝতে পারত আমি কী চাই’, সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সত্যজিৎ। আর লিখেছিলেন, ‘তার প্রতি আমার নির্ভরশীলতা আমার শিল্পীজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় থাকবে’। উল্টোদিকে সৌমিত্র লিখেছিলেন, ‘সারাজীবনে মানিকদার ছবিতে আমি প্রাণ খুলে যথেষ্ট স্বাধীনতা নিয়ে অভিনয় করতে পেরেছি। স্বাধীনতা গ্রহণ করার যে আত্মবিশ্বাস, তা ওর কাছেই পেয়েছি’।
অপু হয়ে-ওঠার জন্য সৌমিত্রকে ‘অপুর সংসার’ এর চিত্রনাট্য দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তার আগে তিনি কোনো অভিনেতাকে চিত্রনাট্য দিতেন না। সঙ্গে দু’টি ফুলস্কেপ পাতায় লিখে দিয়েছিলেন অপু চরিত্রটি নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণে দেখা নিজস্ব ভাবনা। পাশাপাশি সৌমিত্রও লিখেছিলেন ‘অপুর ডায়েরি’ এবং অপু সম্পর্কিত নিজের অভিজ্ঞতায় ভর-করা কল্পনা। এখনও যখন সে ছবি তৈরির স্মৃতিতে ফেরেন সৌমিত্র, তখন তিনি লেখেন, ‘বাস্তবতাকে মাপকাঠি করে অভিনয়ের ওই যে চেষ্টা, ওটাই অভিনয়ের আসল অভিপ্রায়’।
আড়াইশোরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। মনে থেকে যায় ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘একটি জীবন’, ‘কোনি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘দত্তা’। নায়ক হিসেবে তিনি তার সমসাময়িক সব নায়িকার বিপরীতেই সাফল্য পেয়েছেন। সম্ভবত তাই তেমন করে কারও সঙ্গে ‘জুটি’ গড়ে উঠেনি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’ ছবিতে সৌমিত্র হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। তেমনই সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, অপর্ণারাও সৌমিত্রের সঙ্গে মিশেছেন অবলীলায়।
২০০৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ২০০৬ সালে ‘পদক্ষেপ’ ছবিতে জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত সৌমিত্র ২০১১ সালে ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পান। ঘটনাচক্রে, তার ছ’বছর পর ২০১৮ সালে তিনি ভূষিত হন ফরাসি সরকারের সেরা নাগরিক সম্মান ‘লিজিয়ঁ দ’নর’-এ।
১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি। চ্যাটার্জি পরিবারের আদিবাড়ি ছিল বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। সৌমিত্রের দাদার আমল থেকে চ্যাটার্জি পরিবার নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন। সৌমিত্র পড়াশোনা করেন—হাওড়া জেলা স্কুল, স্কটিশ চার্চকলেজ, কলকাতার সিটি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শিক্ষাবার্তা/এসজেড