চবিতে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগে একের পর এক বিতর্ক
একের পর এক শিক্ষক নিয়োগ বিতর্ক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে যেন আঁকড়ে ধরেছে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ আর অভিযোগের শেষ নেই। কেউ কেউ বলছেন, উপাচার্য তার শেষ মেয়াদে এসে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কোনো প্রকল্পের দিকে দৃষ্টিপাত করার সময় নেই। এ নিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই অবস্থায় গত ১২ মার্চ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্ষদ থেকে মোট ১৯ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম। যেটি নজির স্থাপন করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্যের সময়ে প্রায় দুই বছরে শিক্ষক ও কর্মচারী পদে ১৮৭ জনের নিয়োগ হয়েছে। এসব নিয়োগে প্রতিবারই ‘বিতর্কের’ সৃষ্টি হয়। কারণ, বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে দেওয়া হয়েছে একাধিক নিয়োগ। বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াও নিয়োগ পেয়েছেন ২৭ জন।
উপাচার্যকে নিয়ে বিতর্কের শুরু যেভাবে:
২০১৯ সালের ১৩ জুন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শিরীণ আখতার। তার সময়ে নিয়োগে বিতর্কের শুরু ২০২১ সালের জুনে। ওই সময় বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে পরিচালিত ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে খণ্ডকালীন হিসেবে ১২ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৫ জনকে। এরপর থেকে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি উপাচার্যের।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়া নিয়ে সমালোচনা ও শিক্ষক সমিতির আপত্তির মধ্যেই আবারও ৭ জন শিক্ষককে অতিরিক্ত নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত ৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪৩তম সিন্ডিকেট সভায় এ নিয়োগ দেওয়া হয়। পরের দিন ৬ মার্চ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন।
এর আগে গত ১ মার্চ বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে উপাচার্যকে চিঠি দেয় চবি শিক্ষক সমিতি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, সিন্ডিকেটের ৫৪৩তম সভায় বিভিন্ন বিভাগে নতুন ২৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিজ্ঞাপিত ৫ জনের বিপরীতে ৭ জন, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে বিজ্ঞাপিত ৪ জনের বিপরীতে ৭ জন, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগে বিজ্ঞাপিত ২ জনের বিপরীতে ৩ জন ও নৃবিজ্ঞান বিভাগে বিজ্ঞাপিত ১ জনের বিপরীতে ২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া, পরিসংখ্যান বিভাগে বিজ্ঞাপিত ৪ জনের বিপরীতে ৪ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
এর আগে সিন্ডিকেটের ৫৩৮তম সভায় বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগ ‘শুদ্ধাচার পরিপন্থী’ উল্লেখ করে অতিরিক্ত নিয়োগ না দিতে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি ওই সভায় বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত ১৩ জন শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে সিন্ডিকেটের ৫৩৯ সভায় পূর্বের সিদ্ধান্তকে কাটছাঁট করে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে চাহিদা বিবেচনা করে বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে কম বা বেশি নিয়োগ দেওয়া যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একইসঙ্গে আগের সিন্ডিকেটে বাতিল করা ১৩ জনসহ ১৭ জনকে অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়া হয়।
এছাড়াও, ৫৪১তম সিন্ডিকেট সভায় বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী মেরিন সায়েন্স ইনিস্টিটিউটে ১ জন এবং ওশানোগ্রাফি বিভাগে ২ জন অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। প্ল্যানিং কমিটিকে উপেক্ষা করে এ নিয়োগ কার্যক্রম চলছে, যা নিয়মবহির্ভূত বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বিভাগ ও দুই অনুষদে সহযোগী অধ্যাপক ও প্রভাষক পদে স্থায়ী ও অস্থায়ী মোট ২১ জন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির বাইরে গিয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগেও দুজন স্থায়ী প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় উপাচার্য বরাবর চিঠি দিয়েছেন সিএসই বিভাগের চার শিক্ষক। তারা হলেন অধ্যাপক ড. মো. আছিয়র রহমান, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সানাউল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক ড. রাশেদ মোস্তফা ও সহকারী অধ্যাপক এ এইচ এম সাজেদুল হক।
শিক্ষকরা বলেন, গত ২৩ জানুয়ারি সিএসই বিভাগের স্থায়ী প্রভাষক পদে দুজন নতুন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বর্তমানে বিভাগে ১৯ জন শিক্ষক কর্মরত এবং ২ জন ছুটিতে আছেন। বিভাগের সব শিক্ষক আন্ডারলোডে থাকায় বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও নতুন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পরিপন্থি।
এদিকে, ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চবির পালি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় নিয়ম ভঙ্গ করে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী অভি বড়ুয়াকে। দুই পদের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও নিয়োগের জন্য ৪ জনকে সুপারিশ করা হয় নিয়োগ বোর্ড থেকে। এর মধ্যে সুপারিশের তালিকায় এক নম্বরেই রাখা হয়েছে সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী অভি বড়ুয়ার নাম।
সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, আমরা আমাদের শিক্ষক সমিতির সিদ্ধান্তের মধ্যে আপত্তি জানিয়েছি। এটা তো হওয়া উচিত না। আমরা যখন আপত্তি জানালাম, এরপর কি হলো আমরা তো আর জানি না। আমরা যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে জানালাম অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ না দেয়ার জন্য, তারপরও শেষ সিন্ডিকেট সভা যেটা শিক্ষক ক্যাটাগরির সিন্ডিকেট নির্বাচনের আগে হয়েছে সেখানেও অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সেটার সঠিক তথ্য আমার কাছ নাই। তবে আবারও এ ধরনের প্রক্রিয়া আছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমরা দেখব যে এটা যাতে আর না হয়।
উপাচার্যের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে তিনি বলেন, এখানে উপাচার্যের নিজস্ব কোন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এটা তো নিয়ম বহির্ভূত। সিন্ডিকেটে এই বিষয়গুলো পাস হয়। সিন্ডিকেটে যাতে এই নিয়ম বর্হিভূত কাজ না হয় সেজন্য আমরা ডিন, প্রভোস্ট ক্যাটাগরির ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের নির্বাচন দিতে বলেছি। উনি দিবেন দিবেন বলছেন। সুস্পষ্ট কোন কথা বলছেন না। সিন্ডিকেটে যাতে কোন অনিয়ম না হয় তাই আমরা শিক্ষক প্রতিনিধি দিয়েছি। আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও পদক্ষেপ নিব।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৮/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়