যেকারণে গবেষণায় পিছিয়ে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা
নিউজ ডেস্ক।।
সারাদেশে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কয়েক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যে জায়গাগুলোতে শিক্ষার্থীরা চার বছর মেয়াদি স্নাতক এবং ১ বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে পারছেন। তাছাড়াও রয়েছে ৩ বছর মেয়াদি স্নাতক (পাস) ডিগ্রি লাভেরও সুবিধা। তবে বিপুল পরিমাণ এসব শিক্ষার্থীদের কতজন বর্তমান আধুনিক সময়ের বৈজ্ঞানিক ধারার শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করছেন সেটি নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। আবার শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের চাহিদার আলোকে বর্তমান ডিজিটাল প্রযুক্তির সমন্বয়ে কতটুকু শিক্ষা দিতে পারছেন সেটিও বড় বিষয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন পাঠ্যক্রমের যথাযথ প্রয়োগ, পাঠদান পদ্ধতি, উপযোগী পাঠ্যসামগ্রীর উন্নয়নসহ কলেজ পর্যায়ে অনার্স-মাস্টার্স শ্রেণির শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে গবেষণা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হওয়ার বিকল্প নেই। কেননা কলেজে পর্যায়ে সারাদেশের বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীদের যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব এসব শিক্ষকরাই পালন করছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য শিক্ষকদের গবেষণা প্রয়োজনীয়। কেননা গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষকরা নতুন প্রযুক্তি এবং উন্নয়ন উপকরণ এবং প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারেন, তারা তাদের শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্কে বেশি সম্পৃক্ত হতে পারেন এবং তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন এবং উন্নয়নশীল পাঠদান ব্যবহার করতে পারেন। তাছাড়া একজন প্রভাবশালী শিক্ষক হওয়ার জন্যও গবেষণা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপায় বলেও মনে করছেন তারা।
তবে বাস্তবিক ক্ষেত্রে রয়েছে উল্টোচিত্র। সারাদেশের সরকারি কলেজের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকরা গবেষণা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হওয়ার পরিমাণ যথেষ্ট নয়। হয় তারা আগ্রহ হারাচ্ছেন, না হয় সুযোগ পাচ্ছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি কলেজের শিক্ষকরা জানিয়েছেন গবেষণা কার্যক্রমে তাঁদের পিছিয়ে পড়ার কারণ।
তাঁরা বলছেন, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজগুলোতে পদায়ন হয়ে থাকে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীর তুলনায় বা চাহিদায় পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় চাইলেও যে কেউ দীর্ঘদিনের জন্য গবেষণা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হতে পারেন না। এরপরও যারা নিজ থেকে উদ্যোগী হচ্ছেন তাদের কেউ ব্যক্তি উদ্যোগেই এসব কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছেনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহায়তা। ফলে শিক্ষকরা গবেষণায় আগ্রহ হারাচ্ছেন।
এ ছাড়াও রয়েছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সেগুলো হলো- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসিত আইন হওয়ায় শিক্ষকরা চাইলেই বাজেটসহ অন্যান্য সুবিধাদি পেয়ে থাকেন কিন্তু সরকারি কলেজের শিক্ষকদের গবেষণা কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাজেট সংকট। আগ্রহী শিক্ষকদের ব্যক্তি-উদ্যোগে খোঁজ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হয়। আবার কলেজে শিক্ষক সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনাগ্রহী মনোভাব, উচ্চ গবেষণা শেষে বিশেষ মূল্যায়ন না থাকা, পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণার অকার্যকারিতা, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদায়ন না হওয়া, অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষসহ কলেজের গুরুত্বপূর্ণ পদে গবেষক শিক্ষকদের অগ্রাধিকার না দেওয়া সহ বিভিন্ন কারণে দেশের সরকারি কলেজগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে কমছে গবেষণার পরিমাণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, গবেষণা করে কি হবে সুযোগ-সুবিধা দুটোর কোনটাই নেই। মূল্যায়নও নেই। যে পরিমাণ স্কলারশিপ, পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন সেটিও নেই। আবার যারা গবেষণা সম্পন্ন সম্পন্ন করে আসেন তাদের মূল্যায়নও করা হয়না। তাই আমাদের মধ্যে গবেষণার প্রতি আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। তবে এর মাঝেও অনেকেই নিজ উদ্যোগে দেশে বিদেষে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হচ্ছেন।
তবে বর্তমান সময়ে উচ্চশিক্ষায় যুগোপযোগী অবস্থা তৈরির জন্য নতুন শিক্ষকদের গবেষণার সুযোগ দেয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক গবেষক প্রফেসর ড. শুকুর আলী। তিনি বলেন, বর্তমান প্রজন্মের নতুন শিক্ষকদের অনেকেই গবেষণায় আগ্রহী হলেও নানা কারণে সেটি সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই গবেষণা কার্যক্রমে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা মনে করেন গবেষণা করে কোন লাভ নেই। বিশেষ কোন মূল্যায়ন নেই। তবে সেটি সঠিক নয়। নিজের জ্ঞানগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। তাই পিছুটান থাকার পরও শিক্ষকদের অনুরোধ করবো যেন তাঁরা নিজেদের বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করেন।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) গবেষণা কর্মকর্তা সেলীনা আক্তার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পদন্নতির জন্য যেমন পিএইচডি প্রয়োজন সরকারি কলেজগুলোতে তেমনটি নেই। এখানে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ বিষয়টি দেখা হয়না। যার কারণে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেন না। তবে এরমাঝেও অনেক নতুন ফেলোশিপ এবং গবেষণার জন্য স্কলারশিপ উন্মুক্ত হচ্ছে। শিক্ষকরাও আগের তুলনায় অনেক বেশি এসবে অংশগ্রহণ করছেন। তবে অংশগ্রহণ আরো বাড়ানো প্রয়োজন।
তবে উচ্চতর গবেষণায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের সহযোগিতার জন্য ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে গবেষণা প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব ড. মো. ফরহাদ হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উন্নত প্রযুক্তির আহরণ, উদ্ভাবন এবং প্রয়োগের বিস্তৃতি সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী গড়ে তোলার জন্য ১১টি গবেষণা ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত ফরমে গবেষণা প্রস্তাব আহ্বান করা যাচ্ছে। যে ১১টি ক্ষেত্রে গবেষণা প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে সেগুলো হলো, গাণিতিক বিজ্ঞান, জীবন সম্পর্কিত বিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, আইসিটি, মেরিন সায়েন্স, এসডিজি এবং ৮ম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক গবেষণা, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, বাংলাদেশের পাবলিক পলিসি, ব্যবসায় শিক্ষা এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন অধ্যয়ন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি সাধারণ, বিশেষায়িত, কারিগরি, কৃষি এবং চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন স্নাতকোত্তর কলেজগুলোর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত শিক্ষক-গবেষক উচ্চতর গবেষণা সহায়তার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এছাড়া সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন বা গবেষণা কর্ম করতে আগ্রহী তারাও আবেদন করতে পারবেন। আবেদন ফরমের নির্ধারিত স্থানে মুখ্য গবেষকের টেলিফোন নম্বর, মোবাইল নম্বর, ই-মেইল, ফ্যাক্স নম্বর উল্লেখ করতে হবে।
গবেষণা সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দিয়েছে মন্ত্রণালয়। শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, আবেদনকারীকে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রজেক্ট কনসেপ্ট নোট বা পিসিএন দাখিল করতে হবে। মৌলিক ও ফলিত গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। মান সম্পন্ন দেশি বিদেশি জার্নালে প্রকাশনা এবং গবেষণা অভিজ্ঞাতা সম্পন্ন আবেদনকারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। আবেদনকারী গবেষক দল বা গবেষক যার আন্তজাতিক বা জাতীয় পর্যায়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপে প্রবন্ধ উপস্থাপনা বা অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা আছে এমন আবেদনকারী প্রাধান্য পাবেন। নূন্যতম গবেষণা অবকাঠামো, চলমান গবেষণা সংখ্যা, গবেষণা প্রকাশনা ও গবেষণা কর্মকাণ্ডের বৈদেশিক সংযোগমান সন্তোষজনক হতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গবেষণার বিষয়বস্তু দেশে প্রয়োগ উপযোগী ও সময়ের প্রেক্ষাপটে জাতীয় চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। গবেষণার বিষয়ে ইতোমধ্যে সাফল্য বা নির্ভরযোগ্যতা বা আশাব্যঞ্জক বুৎপত্তি (Achievement) অর্জন করেছেন এমন আবেদনকারীকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এ কর্মসূচির আওতায় আবেদনকারীর কোনো চলমান গবেষণা থাকতে পারবে না।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, আবেদনপত্র আগামী ৩০ জুনের মধ্যে আবশ্যিকভাবে প্রজেক্ট কনসেপ্ট নোট ফরম পূরণ করে অনলাইনে নির্ধারিত লিংকের (http://202.72.235.210/gare) মাধ্যমে পাঠাতে হবে। নির্ধারিত ফরম ছাড়া ও অসম্পূর্ণ কোনো আবেদনপত্র গ্রহণ করা হবে না। গবেষকরা সারা বছর ধরে অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন। তবে কেবলমাত্র ৩০ জুনের মধ্যে পাওয়া আবেদন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য বিবেচ্য হবে। আবেদনকারীকে গবেষণা প্রস্তাবের বিষয়বস্তুর গুরুত্ব, সাফল্য-সম্ভাবনা, গবেষণার আবশ্যকীয় বিষয় ও গবেষণা খাতে ব্যয়ের যৌক্তিকতা পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে প্রাথমিক বাছাই বা জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সামনে প্রয়োজনে উপস্থাপন করতে হবে।
গবেষণা সহায়তা কর্মসূচির বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত নীতিমালা ও পিসিএন ফরম নির্ধারিত ওয়েবসাইটে (http://202.72.235.210/gare) থেকে সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে গবেষকদের।