খায়রুল হাবিব স্যারের প্রবন্ধ "বাঁশ"
আমার জন্মের ইতিহাস নিয়ে আজও কোনো ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ ঘেটে ইতিহাসে স্থান দেবার প্রয়োজনীয়তা মনে করেননি। কোনো প্রত্নতাত্তিক প্রস্তর খুঁড়ে প্রদর্শনের জন্য জাদুঘরে স্থান করে দেননি। কোনো বিজ্ঞানীর বিশেষ জ্ঞানে যেখানে অণু-পরমাণুও স্থান পেয়েছে সেখানে চুলচেরা বিশ্লেষণীর বালুকণা হয়ে প্রযুক্তির দুনিয়ায় আমার অবস্থান জানান দেবার যোগ্যতা বুঝি আজও আমার হয়নি আর ভবিষ্যতে হবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
তবে জ্ঞানী-গুণিদের ভবিষ্যত পেশা নির্ধারণে আমার নাম এক-দুইবার পড়েননি কিংবা বিজ্ঞ জুরি বোর্ডের সম্মুখে প্রশ্নের সম্মুখীন হননি এমন ব্যক্তি পৃথিবীতে বিরল। প্রাকৃতিক কিংবা অপ্রাকৃতিক পৃথিবীর বৃহত্তম/ শ্রেষ্ঠ যে সকল বিষয়ের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেছে আমার বিশ্বাস আমি ব্যতীত সকলের অবস্থান সুনির্দিষ্ট পরিমণ্ডলের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ভাবছেন আমি আত্ম-জাহির করছি। সেটি হতে পারে। অবশ্য আপনাদের সুধী মহলে নিজের বীরত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা অন্যায়,অনেকক্ষেত্রে অপরাধের সামিল। যাই বলেন, আমার এই আত্ম-জাহির করায় আমার কোনো দোষ নেই। আপনারাই আমাকে বড় করে তুলেছেন, আপনারাই আমার আত্ম-জাহিরের সুযোগ করে দিয়েছেন। তাই অপরাধ যদি হয় সেটি আপনাদেরই,আমার নয়।
মাঝে মাঝে আপনাদের প্রতি আমার ভীষণ ক্ষোভ হয়। মনে হয়, আপনাদের বিচার-বুদ্ধি একবারেই লোপ পেয়েছে। ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে আপনারা যে নিজেদেরকে বড় জ্ঞানী ভাবেন আমার মনে হয়, তা আপনাদের অজ্ঞতা আর অহমিকার মূল। গুণাগুণ-কার্যকারিতা-ক্ষমতা বিচার না করেই আপনারা যে কোনো কিছুকেই বড়, শ্রেষ্ঠ, ভালো, সুন্দর ইত্যাদি উপমায় অভিষিক্ত করে বসেন। আপনাদের জ্ঞান-গরিমা আর বিচার-বুদ্ধি দেখে আমি একটা বিষয়ে জ্ঞাত হয়েছি যে, আপনারা কেবল চাটুকারিতা আর মোসাহেবী ছাড়া কিছুই শিখতে পারেননি। নইলে আপনাদের বিবেচনায় হজমে দুঃসাধ্য কাঁঠালও যখন জাতীয় ফল হয়, গুণাগুণ বিচার না করেই যখন আপনার প্রিয় মানুষটির জন্য প্রিয় উপহার গোলাপ-ই হয়, প্রিয়-মিলনের শ্রেষ্ঠস্থানটি যখন পঁচা-আবর্জনা ঘেরা নিষ্কর্মা ঝাউগাছটির তল হয় তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে-আপনাদের বোকার স্বর্গে বসবাস।
আপনাদের ছুঁৎমার্গ দেখে আমার ঘৃণা হয়। আপনাদের প্রিয় মসজিদ-মন্দির-গির্জার সমাবেশে করেছেন অবস্থান ভেদ। অথচ আপনাদের কথার তোড়ে ষোলো আনাই অসাম্প্রদায়িকতার ধোঁয়া ওড়ে। মেথর-মুচি-ব্রাহ্মণ-ক্বারি-বাদশা-ফকির যাই বলেন আমার কাছে নেই ভেদ। এই যে, আপনারা যারা নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবী করেন তারাই আমাকে অবাঞ্চিত-অপাঙ্ক্তেয় জায়গায় ফেলে রেখেছেন। সময়ে অসময়ে আপনাদেরই উচ্ছিষ্ট আমার উপর ছুঁড়ে ফেলছেন। আপনাদের কর্মফলেই যখন দুর্গন্ধে বাতাস ভারি হয়েছে তখন নাক শিটকিয়েছেন, নাকে-মুখে কাপড় গুঁজে নিজেদের কীর্তিকে ঢেকেছেন।
আপনাদের মতো অবিবেচক প্রাণী দেখে আমার হাসি পায়। ঘর থেকে বাহির, গ্রাম থেকে নগর, নিচু থেকে উঁচু, একাল থেকে সেকাল, শিশুকাল থেকে বৃদ্ধকাল আপনাদের কত প্রয়োজনের সঙ্গী-ই না হয়েছি। আপনাদের শক্তির হাতিয়ার হয়ে প্রতিপক্ষকে শক্ত হাতে দমন করে বিজয়ের নিশানা উড়িয়েছি। অপমান সহ্য করা যায় কিন্তু অপব্যবহার সহ্য করা যায় না। আপনারই আমাকে আপনাদের খেলনার উপকরণ যেমন করেছেন আবার সুউচ্চ অট্টলিকার অটুট বন্ধনের ভীত করতেও এতটুকু দ্বিধা করেননি। আপনাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্মানটুকু পাইনি। আপনাদের কৃতঘ্নতার কারণে আমার অবস্থান হয়েছে ভাগাড়ে।
আমার ওপর এমন অবহেলা-অবিচারের অভিযোগ তুলে আমি হয়ত সভা-সমাবেশ করতে পারতাম। পারতাম কাজির দরবারে আপনাদের অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে বিচার দিতে। জেল-জরিমানার অতিরিক্ত ফাঁসির কাষ্ঠেও হয়তো ঝুলাতে পারতাম। তাতেও কী আপনাদের অন্তর্চক্ষু খুলতো?
প্রণয়ের আবেগ আসলেই আপনারা সবাই কবি হয়ে ওঠেন। আপনাদের কবি প্রতিভার গুণে অবশ্য মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। কী অসম্ভব সুন্দর সেই প্রতিভা! আবেগে পড়লে আপনারা জাদু-সোনা-মধু বলে আঁকড়ে ধরেন, আর ঘোর কেটে গেলে উচ্ছিষ্টে হয় তার অবস্থান। কী শিক্ষা-ই না আপনারা পেয়েছেন।
আপনাদের মতো জ্ঞানীদের দেখে মনে হয়, আপনাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ফল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। আপনাদের মতো বিজ্ঞরাই যখন একে অপরের ওপর আমাকে দিয়েই নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধির পরিমাপ করেন তখন বোধ করি আমার চিরকালের স্বাভাকিত্বটাই হারিয়ে ফেলার সঙ্কায় থাকি। আর ভাবি, আপনারা আপনাদের মনুষ্যত্ব হারিয়ে প্রাণিমহলে শ্রেষ্ঠ হয়ে খুশি হতে পারেন কিন্তুআমি আমার স্বাভাকিত্ব নিয়েই থাকতে চাই। পরিশেষে আপনাদের পরপারে যাবার প্রথম বাহন হয়েই নিজের পরিচয়টা দিতে চাই- আমিই সেই ‘বাঁশ’।
লেখক -খায়রুল হাবিব
প্রভাষক, রংপুর ক্যাডেট কলেজ, রংপুর।