খন্ডিত উৎসব ভাতা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য অপমান জনক
♦ ফিরোজ আলম♦
উৎসব মানে সাধারণত সামাজিক, ধর্মীয় এবং ঐতিহ্যগত প্রেক্ষাপটে পালিত আনন্দ অনুষ্ঠানকে বোঝায়।সেই হিসেবে বাংলাদেশে তিন প্রকারের উৎসব বেশি দৃশ্যমান।
ক• বাংলায় প্রচলিত লোকায়িত উৎসব:এর মধ্যে রয়েছে পহেলা বৈশাখ, চৈত্র সংক্রান্তি,বর্ষা উৎসব, শরৎ উৎসব, নবান্ন উৎসব, পৌষ মেলা ও পৌষ পার্বণ বসন্ত উৎসব ইত্যাদি।
খ• হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বার্ষিক উৎসব: এর মধ্যে রয়েছে জন্মাষ্টমী, রথযাত্রা, দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা।
গ• মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব:
এর মধ্যে রয়েছে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা,ঈদে মিল্লাদুন্নবী,শবে মিরাজ,শবে বরাত,শবে কদর অন্যতম।
তবে যারা সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষক- কর্মচারী তাদের জন্য উৎসব মানে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।অবশ্য গত দু বছর ধরে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দ্বারা প্রবর্তিত পহেলা বৈশাখ ও এখন শিক্ষকদের কাছে উৎসব বলে বিবেচিত।কারন উৎসব মানেই উৎসব পালনের জন্য বোনাস টাকা।
বোনাস ইংরেজী শব্দ। যার বাংলা উৎসব ভাতা, অধিবৃত্তি, উপরিলাভ অর্থাৎ প্রত্যাশার অতিরিক্ত কোন কিছু।সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত,এবং এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী বেতন ভাতা ও বোনাস নির্ধারিত হয়।কেউ বোনাস বা উৎসব ভাতা থেকে বঞ্চিত হলে তিনি শ্রম আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন।বর্তমানে বোনাস ব্যবস্থায় করুন বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।কারো বোনাস ৪ আনা,কারো ৮ আনা আবার কারো ১৬ আনা।অথচ সবাই উৎসবকে সমানতালেই বিবেচনা করে।উৎসব ভাতার এই বৈষম্য যেমনি চরম অসন্তোষ তৈরি করতে পারে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মাঝে তেমনি অস্থিরতা বাড়াতে পারে শিক্ষক ও শিক্ষাঙ্গনের মাঝে।
সরকারি চাকুরিজীবিদের প্রধানত ২টি উৎসব ভাতা থাকে।আর তা মূল বেতনের সমপরিমান। তাদের জন্য আরো রয়েছে ৪৫%মাসিক বাড়ি ভাড়া,নববর্ষের ২০% উৎসব ভাতা, প্রতিমাসের বেতনের সাথে এক সন্তান থাকলে কমপক্ষে ৫০০ টাকা,দুই সন্তান হলে ১০০০ টাকা শিক্ষা সহায়তা ভাতা, চিকিৎসা ভাতা মাসিক সর্বনিন্ম ১৫০০ টাকা থেকে ২৫০০টাকা ,মৃত্যু বরন করলে পরিবার পাবে সাড়ে আট লাখ টাকা ভাতা।
এর পাশাপাশি সরকার প্রদত্ত ৪০০ টাকা স্বাস্থ্য ও দূর্ঘটনা বীমা । ১০ নাম্বার থেকে ১৬ নাম্বার গ্রেডে চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে যাতায়াত ভাতা মাসে ৩৬০ টাকা। ৩ নং গ্রেডের উপরের কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে গাড়ি সুবিধার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৪র্থ গ্রেডের কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার বিষয়টি বিবেচনার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।মাসে টিফিন ভাতা ৩০০ টাকা। এছাড়া রয়েছে শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা।সকল শ্রেণীর সরকারি চাকরিজীবীকে বর্তমান প্রচলিত প্রতি তিন বছরের স্থলে ২ বছর অন্তর ১৫ দিনের গড় বেতনে অর্জিত ছুটিসহ ১ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা হিসাবে সুপারিশ করা হয়েছে।৪র্থ শ্রেণীর চাকরিজীবীদের জন্য ধোলাই ভাতা মাসে ১৫০ টাকার সুপারিশ করা হয়েছে।
কার্যভার ভাতা সর্বোচ্চ সীমা মাসে ২ হাজার ৫০ টাকা উন্নীত করা হয়েছে।রয়েছে গৃহকর্মী ভাতা,পোশাক পরিচ্ছদ সুবিধা,২০% হারে পাহাড়ি ও দুর্গম ভাতা। হাওড়-বাওড়, দুর্গম দ্বীপ অঞ্চলে উপকূলীয় ভাতা।
উচ্চ পদস্থদের জন্য রয়েছে আপ্যায়ন ভাতা।মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মূখ্য সচিব ৩ হাজার টাকা, সচিব ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তা ২ হাজার ৫০০ টাকা, অতিরিক্ত সচিব ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তা ২ হাজার টাকা, যুগ্ম সচিব ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ১ হাজার ৫০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে।রয়েছে ভ্রমণ ভাতা।বদলিজনিত ভ্রমণ ভাতা এককালীন সড়ক পথে ১০০ কি.মি. পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা, ১০১ থেকে ২০০ কি.মি. পর্যন্ত ১৫ হাজার ৫০০ টাকা, ২০১ থেকে এর বেশি কি.মি. হলে ২০ হাজার টাকা ভ্রমণ ভাতা। আরো রয়েছে পেনশনযোগ্য চাকরিকাল। প্রথম গ্রেড থেকে ১৬ গ্রেড পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পেনশনযোগ্য চাকুরিকাল ৫ বছর থেকে শুরু করে ২৫ বছর ।এ সময় পেনশনের হার গ্রেড অনুযায়ী ২০ শতাংশ থেকে গ্রেড অনুযায়ী ৯০ শতাংশ ।
রয়েছে আবাসন ও গৃহ নির্মাণ ঋণ প্রজেক্ট।সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ঋণের পরিমাণ গ্রেড অনুযায়ী ১২ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা গৃহ ঋণ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।এক্ষেত্রে সুদের হার হবে ব্যাংক রেটে ৫ শতাংশ। এর পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে খাস জমি চিহ্নিত করে সরকারি চাকরিজীবীদের আবাসনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা।৮ম থেকে ১ম গ্রেড স্কেলের কর্মকর্তাদের ২০ জনের জন্য ১০ কাঠা ও অন্যান্য চাকরিজীবী প্রতি ২০ জনের জন্য ৮ কাঠা প্লট দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া আরো অনেক সুবিধাই রয়েছে।উপরিউক্ত সুযোগ সুবিধা তারা পান আমি মনে প্রানে তা চাই ও বটে।একজন মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে ভালভাবে জীবন ধারনের জন্য উপরিউক্ত সুবিধা সমূহ অপরিহার্য।কিন্তু সমস্যা হল এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে।
এমপিওভুক্ত ষিক্ষকদের উৎসব ভাতার ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায় , ২০০৩ সাল থেকে
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেওয়া এক সিদ্ধান্তের ফলে সারাদেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি প্রায় ৫ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে উৎসব ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০০৩ সালের অক্টোবর থেকে তা কার্যকর হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয়, শিক্ষকদের মূল বেতনের ৫০ শতাংশ দুই ঈদে ২৫%+২৫% শতাংশ করে ভাগ করে তা দেওয়া হবে। সেই থেকে প্রতি ঈদে শিক্ষকরা ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা পান। আর কর্মচারীদের জন্য ওই সভায় ১০০% অর্থাৎ ৫০%+৫০% দুই ঈদে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
যখন এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল তখন সরকার থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ৯৫ শতাংশ বেতন দেওয়া হতো। ২০০৫ সালে সরকার শিক্ষকদের বেতন ৫ শতাংশ বাড়িয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের শতভাগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও উৎসব ভাতা আর বাড়ানো হয়নি। সেই থেকে অর্থাৎ ১৭ বছর ধরে মানুষের জীবন-জীবিকার চাহিদা বেড়ে কয়েক গুন হলে ও কিছু অদৃশ্য অশুভ শক্তির কারনে এই লজ্জাজনক খন্ডিত উৎসব ভাতা আজ ও বিদ্যমান।অথচ এটি ১০০% হওয়া শিক্ষকদের যেমনি প্রানের দাবি,তেমনি সন্মানের প্রশ্ন ও এটি অতীব জরুরি।এদিকে, বরাবরের মতোই সর্বশেষ উৎসব ঈদুল আজহায় ও খণ্ডিত উৎসব ভাতা পেয়েছেন শিক্ষকরা। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত ঈদুল আজহায় সারাদেশের ২৬ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা মিলে ২৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি উৎসব ভাতা
দিয়েছেন ।এর মধ্যে শুধু স্কুল ও কলেজ শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য ঈদ বোনাস বাবদ দিয়েছেন প্রায় ১৯৫ কোটি টাকা। বাদ বাকি মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের জন্য।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক মানে সমাজের নিগৃীহিত করুনার পাত্র, যাদেরকে দেয়া হয় অনুদান ,সে অনুদান উৎসবের সময়ে ও অনুদান ই থাকে। আর সে অনুদান থেকে বের হতে, আত্ম সন্মান ফিরে পেতে সারা দেশের শিক্ষকরা যখন একমত,ঠিক তখনি কিছু কুরুচিপূর্ন শিক্ষক নেতা যারা আন্দোলন না করেই অতীতে ও সুবিধা নিয়েছে এখন ও নিচ্ছে তারাই শিক্ষকদের আশা গুলিকে বুট জুতোয় থেথলে দিচ্ছে।
সরকারি চাকুরিজীবিদের বোনাস মুল বেতনের ১৬ আনা হলে ও বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় তা ৪ আনা ও কর্মচারিদের বেলায় তা ৮ আনা পরিমাণ৷ একই এলাকার কিংবা একই বাড়ির কিংবা একই পরিবারের ২ জন সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকের পোশাক, তাদের ছেলে সন্তান,পরিবার পরিজনের উৎসবের দৃশ্য কি ভিন্ন? সরকারি- বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য উৎসবের সংজ্ঞা ভিন্ন কিনা তাও আমার বোধগম্য নয়।
অথচ তারা ২জন শিক্ষকই দেশের জন্য,শিক্ষার জন্য,শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য,জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে সমান অবদান ই রাখছেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষকের ছেলে মেয়েরা ঈদ করবে কাদের সাথে? সরকারি অফিসের একজন পিয়ন, বেসরকারি শিক্ষকের চেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি বোনাস পায়৷ সে ক্ষেত্রে জাতি গড়ার কারিগরের সম্মানটা থাকে কোথায়?
দেশের শিক্ষা বাজেট আগের তুলনায় প্রতিবার ই বাড়ে শুধু কমছে কিংবা কর্তন হচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন ৷ প্রতিযোগিতামুলক নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে যারা নিবন্ধন পাস করেছেন তারাই কেবল বর্তমানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন,পাচ্ছেন৷ তারা ও এদেশের নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত গ্রাজুয়েট। তবে কেন তাদের জন্য আলাদা বেতন কিংবা লজ্জাকর ৪ আনা উৎসব ভাতা?
দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিরা ১০০% বোনাস পেয়ে ও খুশি হতে চান না,তাহলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ২৫%লজ্জাজনক বোনাস পেয়ে কিভাবে উৎসবে মাতবেন? সরকারি বিধি মাফিক পিতামাতাসহ ছয় সদস্যের পরিবারের ঈদ উৎসব ভাতা ১০০%হলে এমপিওভুক্তদের বেলায় অবিচার কেন?ঈদের কেনাকাটা কিংবা ঈদ পোশাক ২৫% উৎসব ভাতায় কী কী কেনা যায় কর্তারা তা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবগত করালে যুগ যুগ ধরে কান্না ও আর্তনাতরত শিক্ষকরা হয়ত শান্তনা টুকু ও পাবেন।
হয়ত সুবিধাভোগীরা বলবে এ দেশ গরিব। এত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকার কী করে শত ভাগ বোনাস দেবে? ঠিক আছে মানলাম।যেদেশে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মান প্রায় শেষের পথে ,হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন মূলক কাজ হচ্ছে,।প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে,করোনায় প্রনোদনা প্যাকেজ লক্ষ কোটির টাকার কাছাকাছি ঘোষনা হয়,সেদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদান কি অসম্ভব কিছু?যদি কেউ মনে করেন এটি নিছক অপচয় তাদের জন্য বলি বাংলাদেশ ব্যাংক কেলেংকারি,শেয়ার বাজার কেলেংকারী, ডেসটিনি কেলেংকারি, হলমার্ক কেলেংকারি,রেল কেলেংকারি,বিমানের হাজার কোটি টাকা লোকসান ইত্যাদি সব কেলেংকারিতে কি দেশের হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়নি?
সব ঠিক ঠাক মত চলছে।কোথাও আটকাচ্ছে না দেশ। শুধু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ১০০% উৎসব ভাতা দিতে সব অভাব অনটন উপর থেকে নাজিল হয়।
পরিশেষে বলব,সরকারি সহযোগিতায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বৈশাখী ভাতা, ৫% ইনক্রিমেন্ট এবং অন্যান্য বেশ সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন।তাই ৪ আনা কিংবা ৮ আনা বাদ দিয়ে অন্যান্য চাকরিজীবীদের ন্যায় এমপিওভুক্ত অসহায় ও অবহেলিত এ দেশের শিক্ষকদেরকে মুজিব শতবর্ষে শতভাগ পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা প্রদান করতে সরকারের দায়িত্বশীল মহলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান এবং সবিনয় অনুরোধ করছি৷
লেখক:-
শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট-