ক্ষমতা লোভীরা নিজেদের জন্যও নিরাপদ নয়
ডঃ মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন ঃ
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে গিয়েও ক্ষমতা ছাড়তে নানা টালবাহানা করে চলেছেন। এখনও তার কথাবার্তার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতা না ছাড়াটাই তার মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ তিনি ক্ষমতার মোহে পড়ে গেছেন। বিভিন্ন দেশের একনায়কদের মতো তিনিও আরেক দফা ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছেন। আরেক দফা বলা হল কারণ, আমেরিকায় পরপর দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে থাকা যায় না। অন্যথায় কে জানে লিবিয়া, ইরাক প্রভৃতি রাষ্ট্রের মতো আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্টের মনেও যুগ যুগ ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতা দেখা দিত কিনা!
আমাদের সবারই জানা, ইরাক ও লিবিয়ায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতার কারণে সে দুটি দেশের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং কর্নেল গাদ্দাফির করুণ দশা হয়েছিল এবং দীর্ঘদিন পর সেসব দেশের মানুষ একনায়কতন্ত্রের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। অবশ্য তাদের গদিচ্যুত করতে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকাই যে কলকাঠি নেড়েছিল, সেটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন।
কারণ, আমেরিকা এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করলে তারা হয়তো আরও কিছুদিন ক্ষমতায় টিকে যেতেন। যাক সে কথা, আমার লেখাটির উদ্দেশ্য যেহেতু ক্ষমতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ক্ষমতালোভী ব্যক্তিদের ক্ষমতা হারানো নিয়ে কিছু বলা, সুতরাং সে বিষয়ে ফিরে আসি।
যেহেতু ক্ষমতা একটি মোহ, তাই যে কারও পক্ষেই তা ত্যাগ করা কঠিন ব্যাপার। কারও জন্যই ক্ষমতা স্থায়ী বা চিরস্থায়ী কোনো বিষয় নয়, এ কথাটি জানা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই তা মানতে চান না। আর তেমনটিই ঘটেছে ট্রাম্প সাহেবের ক্ষেত্রে। ফলে তিনি যে পরাজিত, তা জানতে-বুঝতে পেরে আরও চার বছরের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে চাচ্ছিলেন! কিন্তু বিধি বাম হওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও এ অসম্ভবকে সম্ভব করতে তিনি কোনো পাঁয়তারাই বাদ রাখছেন না। বিভিন্ন ফন্দিফিকির অব্যাহত রেখে শেষ পর্যন্ত তিনি সফল না হলে তবেই হয়তো ক্ষমতা ছাড়বেন।
ট্রাম্পের গতবারের ক্ষমতাপ্রাপ্তির বিষয়টিও অত্যন্ত চমকপ্রদ। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে যেভাবে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, সে ঘটনাটিও সারা পৃথিবীর মানুষ বহুদিন মনে রাখবেন। কারণ, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই ভেবেছিলেন, হিলারি ক্লিনটনই প্রেসিডেন্ট হবেন; কিন্তু তা হননি। যদিও আমরা যারা ইহুদিদের শক্তির কথাটি মাথায় রেখে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলাম, ‘যেহেতু ইহুদিরা ট্রাম্পের পক্ষে, তাই ট্রাম্পের জেতার সম্ভাবনাই বেশি,’ আর আমাদের সে ভবিষ্যদ্বাণী ফলেও গিয়েছিল; কিন্তু এবারে তা সম্ভব হয়নি। কারণ, ইহুদিরাও এবার দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। তাছাড়া ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র, খামখেয়ালিপনা, করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থতা প্রভৃতি বিষয়ও তাকে ডুবিয়েছে। আর সে কারণেই ঘটেছে বিপত্তি।
বর্তমানে ট্রাম্প ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এমন একজন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি জানেন অচিরেই তাকে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হবে। এ অবস্থায় আমেরিকার মতো দেশের প্রেসিডেন্টের পদ হারানো তো যে-সে বিষয় নয়। সেখানে কোনো ব্যক্তির ক্ষমতার শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে তাকে ক্ষমতার লোভ পেয়ে বসতেই পারে। যদিও আমেরিকার মতো দেশে এমনটি না হওয়ারই কথা। তাই বলে মাঝেমধ্যে একদম এমন কিছু যে ঘটেনি, তেমনটিও কিন্তু নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ট্রাম্পের মতো এতটা বেশি না হলেও আরও কেউ কেউ ক্ষমতা ছাড়তে গড়িমসি করেছেন বৈকি বা ক্ষমতার শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে পরাজয়ের পরও টিকে থাকতে চেষ্টা করেছেন।
উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নিঃসন্দেহে ক্ষমতা একটি লোভ বা মোহ। আর সে লোভ সবাই সংবরণ করতে পারেন না। ক্ষমতার মোহে অনেক সময় নিজের জীবন পর্যন্ত অনিরাপদ করে ফেলা হয়! ক্ষমতার চোরাবালিতে ডুবে অনেকে জীবন বিসর্জন দিলেও মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের অনেকে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করেন না বা করতে চান না। যেমনটি ঘটেছিল লিবিয়া ও ইরাকের রাষ্ট্রনায়কদের ক্ষেত্রে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে আজ এ মুহূর্তে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে যা দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই তেমনটি ঘটে থাকে। তবে আমেরিকা বলে সারা বিশ্বে এ বিষয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। অন্যথায় খোঁজখবর করলে বিশ্বের অনেক দেশেই নির্বাচন, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রভৃতি বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে; যেখানে বিভিন্ন কায়দা-কৌশল-ছলচাতুরী প্রভৃতির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
আর এসব ঘটনার কারণও একটিই, যা হল একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে বসলে সহজে সেখানকার মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে না পারা বা বেরিয়ে আসতে না চাওয়া। যারা একটি নির্বাচনের মাধ্যমে পরাজিত হলে সুন্দর ও স্বাভাবিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন বা করতে চান, তাদের কথা বাদ দিলে পৃথিবীতে এমন অনেক রাষ্ট্রনায়ক আছেন, এমন অনেক রাজনৈতিক দল আছে, যারা পরাজিত হলেও সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চান না।
বস্তুত সব ধরনের ক্ষমতাই মানুষের মনে মায়াজাল সৃষ্টি করে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এমন একটা বিষয়, এমন একটি শৃঙ্খল, যার মায়া কাটানো মুশকিল। ক্ষমতা পেলে বা ক্ষমতায় গেলে একদিন সে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হবে বা ছেড়ে আসতে হবে, এ মনমানসিকতা নিয়ে কারা বা ক’জন রাজনীতি করেন তা বলা সম্ভব না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করা হয়।
যুগে যুগে সারা পৃথিবীতে তেমনটিই দেখা গেছে। ক্ষমতার লোভ নেই বা ক্ষমতার লোভ সংবরণ করতে পারেন এমন নেতা পৃথিবীতে খুব কমই পাওয়া গেছে। আর যাদের পাওয়া গেছে তারা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও অন্যরা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। ক্ষমতালোভী এ শ্রেণির নেতারা নিজেদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার পাশাপাশি দেশের মানুষের নিরাপত্তাও বিনষ্ট করেছেন। ওই শ্রেণির নেতা বা রাষ্ট্রনায়কের কারণে দেশে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেসব দেশে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ঘটেছে এবং রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছে।
ফলে সেসব দেশের নারী-শিশুসহ হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। সিরিয়ার এমন সব ঘটনায় শিশু আইনাল কুর্দির করুণ মৃত্যুর কথা আমরা এখনও ভুলতে পারিনি। সাগরে ভেসে আসা তার সেই লাশ আজও আমাদের কাঁদায়! ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দিনের পর দিন সেখানকার মানুষের জানমাল তোপের মুখে উড়ে যাচ্ছে, ভস্মীভূত হয়ে যাচ্ছে। আজ সিরিয়ার দিকে তাকালে যে কোনো মানুষের মনপ্রাণ কেঁদে ওঠে!
আশ্চর্যের কথা, আমেরিকার মতো দেশেও ক্ষমতার ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে! ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সেখানকার মানুষের জীবনেও অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে। ট্রাম্পের লোকেরা অস্ত্রের দোকানের প্রায় সব অস্ত্র কিনে নিয়েছেন। এ অবস্থায় দোকান লুটের ভয়ে অনেক অস্ত্রের দোকান বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া লুটপাটের ভয়ে অন্য কিছু দোকানপাটও বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
আর এসবের কারণ হল, ‘পলিটিক্যাল টারময়েল’। যে কোনো মুহূর্তে সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়ে মানুষের জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল। যে আমেরিকা উন্নত বিশ্বের প্রতিভূ হিসেবে মানুষের জানমালের জন্য অধিকতর নিরাপদ ছিল, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আজ সে দেশের মানুষের জানমালও হুমকির সম্মুখীন! আর এসবের কারণ হল যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা।
অথচ পৃথিবীর দেশে দেশে ক্ষমতাপাগল কোনো নেতা বা দল এসব করতে গিয়ে একবারও ভেবে দেখেন না, এসব কর্মকাণ্ডে জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তাসহ অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়; হুমকির সম্মুখীন হয়। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সবাই নিজেদের জন্য নিজেরা নিরাপদ কি না, সে কথাটি ভেবে দেখলে তারা নিজেরাসহ তাদের দেশের মানুষও নিরাপদবোধ করবেন। অন্যথায় ক্ষমতালোভী এসব নেতার কারণে তাদের দেশ এবং দেশের মানুষেরও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। কারণ, যারা নিজেদের জন্য নিজেরা নিরাপদ নন, তারা তাদের দেশ এবং দেশের মানুষের জন্যও নিরাপদ নন।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
শিক্ষাবার্তা/ বিআ