কোনো শিক্ষার্থী বাদ পড়বে না পাঠগ্রহণ ও অনুশীলনে
নিজস্ব প্রতিনিধি।।
কোনো শ্রেণির ক্লাসে যখন শিক্ষক পাঠদান করবেন তখন সামনে বসা শিক্ষার্থীর কেউ যেন পাঠগ্রহণ ও অনুশীলনে বাদ না যায়, সেদিক লক্ষ্য রেখে নতুন কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্কে পাঠপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে পেছনের সারির শিক্ষার্থীরাও যেন সমান মনোযোগী হয়, ক্লাসের পাঠে সেদিকে জোর দেওয়া হয়েছে নতুন পরিকল্পনায়। এ পাঠ থেকে একজন শিক্ষার্থীর শিখনযোগ্যতাও মূল্যায়ন হবে।
নতুন কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্কে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এর পরিবর্তে মুখস্থ পড়ালেখার বিপরীতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অনুধাবন, জ্ঞানার্জন, অনুভূতি ও মনন বিকাশে।
নতুন কারিকুলামে বলা হয়েছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে মূলত মুখস্থ বিদ্যা মূল্যায়িত হয়। এটি প্রকৃত মূল্যায়ন হতে পারে না। আসলে মুখস্থ বিদ্যা নয়, বরং বিষয়বস্তুকে কতটুকু আত্মস্থ করা হয়েছে, তার মূল্যায়ন করা গেলেই শিক্ষার প্রকৃত মূল্যায়ন করা সম্ভব। বর্তমানে যে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু আছে, সেটি আত্মস্থ করা বিদ্যা মূল্যায়নের একটি প্রক্রিয়া।
এই পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগ নির্ভর করবে উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল রেখে যথাযথ পাঠ্যপুস্তক, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের নিয়মকানুন নির্ধারণ করা এবং প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার তা যথাযথভাবে বুঝতে পারার ওপর। কাজেই এ বিষয়ে যথাযথ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, নিয়মকানুন নির্ধারণ এবং সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞান সৃষ্টি করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে মুখস্থ বিদ্যাভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে সরে এসে বহুমাত্রিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন মাত্রার জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, গুণাবলি ও চেতনা বিকাশের ধারাকে মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়েছে। সব ধরনের শিখন মূল্যায়নের ভিত্তি হবে যোগ্যতা।
এতে গতানুগতিক পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়ন হ্রাস হবে। চালু হবে বিকল্প মূল্যায়ন (স্ব-মূল্যায়ন, সহপাঠী বা দল কর্তৃক মূল্যায়ন ইত্যাদি)। এই পদ্ধতিতে মূল্যায়নের মূলনীতি অনুসরণ করে নিশ্চিত করা হবে শিক্ষার্থীর যোগ্যতার মূল্যায়ন। ক্লাসের পাঠেও ভিন্নতা আসবে। ক্লাসে শিক্ষক যখন পাঠদান করবেন ও অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন, তখন সব শিক্ষার্থীকে সমন্বয় করে দল তৈরি করে দেবেন। তারা দলগত অনুশীলন করবে। কোনো শিক্ষার্থী আর শিক্ষকের দৃষ্টির বইরে থাকবে না। সবাইকে ক্লাসের পাঠে মনোযোগী হতে হবে। এমনকি মূল্যায়নের ধারাবাহিক রেকর্ড সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় আসবে নতুনত্ব।
অধ্যাপক মশিউজ্জামান আরও বলেন, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও গুণাবলির মধ্যে আন্তঃস¤পর্ক বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যতার পরিমাপ করা। কাজেই জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও গুণাবলিকে পৃথকভাবে মূল্যায়ন না করে এই উপাদানগুলোর মিথস্ক্রিয়ায় অর্জিত সক্ষমতার মূল্যায়ন জরুরি।
জানা গেছে, নতুন কারিকুলামে মূল্যায়ন নির্দেশকগুলো হলো- শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বহুমাত্রিক উপায়ে মূল্যায়ন, শিখনের জন্য মূল্যায়ন, মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন ও পর্যবেক্ষণ, প্রতিফলনভিত্তিক ও প্রক্রিয়ানির্ভর মূল্যায়ন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন, সতীর্থ ও অংশীজনদের মূল্যায়ন, মূল্যায়নে প্রযুক্তির (অ্যাপস) ব্যবহার, মূল্যায়নে জ্ঞান দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের লেখাপড়া হয়ে গেছে প্রাইভেট কোচিং আর পরীক্ষানির্ভর। এখান থেকে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে সরকার; এটি ইতিবাচক। বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শুধু জ্ঞান অর্জন করলে চলবে না। অর্জিত জ্ঞানকে পরিবেশ অনুযায়ী অভিযোজনের জন্য প্রয়োগ করার দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিও অর্জন করতে হবে। তবে এ জন্য আমাদের শিক্ষকদের যথোপযুক্ত দক্ষতার প্রয়োজন আছে। দক্ষ শিক্ষক না পেলে আমরা যত পরিকল্পনাই করি, তা যথাযথ বস্তবায়ন কষ্টসাধ্য হবে।
নতুন কারিকুলামের রূপরেখা অনুযায়ী, বিভিন্ন পর্যায় ও স্তরের শিখন-শেখানো কৌশল নির্ভর করবে শিক্ষার্থীর শিখন চাহিদা, বিকাশের পর্যায় ও আগ্রহের ওপর। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিখন-শেখানো কৌশল প্রধানত হবে খেলা, ক্রিয়াকলাপভিত্তিক ও অনুসন্ধানমূলক। টিম টিচিং বা ব্লক টিচিংকে উৎসাহিত করা হবে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন খেলা ও কাজের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে শিখনে অংশগ্রহণ করবে এবং আনন্দের সঙ্গে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, গুণাবলি ও চেতনার উন্নয়ন ঘটাবে।
শিখন-শেখানো পদ্ধতির অংশ হিসেবে প্রধানত গাঠনিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন নিশ্চিত করা হবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিখন-শেখানো কৌশলের পরিসর হবে আর একটু বৃহত্তর ও সমন্বিত। শিক্ষার্থীদের শিখনে খেলা ও হাতে-কলমে কাজের পাশাপাশি অনুসন্ধানমূলক শিখন ও সমস্যা সমাধানমূলক শিখনকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিখন-শেখানো কৌশল হবে আরও সংগঠিত। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের শিখন পরিচালিত হবে।
সব শ্রেণিতে বিভিন্ন শিখন-শেখানো কৌশল প্রয়োগের পাশাপাশি সুসংগঠিত অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানো কৌশলের (প্রজেক্টভিত্তিক শিখন) মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উঁচুস্তরের চিন্তন দক্ষতা অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকবে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিখন-শেখানো কৌশল বাস্তবায়নে প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষকের ব্যবস্থা থাকবে। শিখন-শেখানো কৌশল হবে বিশেষত অভিজ্ঞতাভিত্তিক।
শিখন-শেখানো কৌশল বিষয়বস্তুনির্ভর না হয়ে হবে প্রক্রিয়ানির্ভর। শিখন-শেখানো কৌশলে প্রয়োজন ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী হাতে-কলমে শিখন, প্রজেক্ট এবং সমস্যাভিত্তিক শিখন, সহযোগিতামূলক শিখন, অনুসন্ধানভিত্তিক শিখন, স্ব-প্রণোদিত শিখনের সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হবে, পাশাপাশি অনলাইন শিখনের ব্যবহারও উৎসাহিত করা হবে।