কোভিড-১৯ ধাক্কা : কেমন চলছে ওপার বাংলার পত্রিকাগুলো
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতেও ক্রমশ থাবা বিস্তার করছে প্রাণঘাতী ভাইরাস নোভেল করোনা। ইতিমধ্যেই ভারত সরকারের নির্দেশ অনুসারে ২১ দিনের লকডাউনে রয়েছে গোটা ভারত। সুনসান চারিদিক। ফাঁকা রাস্তাঘাট। নেহাত প্রয়োজন না হলে কেউ বের হচ্ছেন না বাড়ি থেকে। এই আতঙ্কের আবহে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির বেশকিছু প্রিন্ট মিডিয়া ইতিমধ্যেই বন্ধ করেছে তাদের প্রিন্ট সংস্করণ।
যে কয়েকটি পত্রিকা লকডাউনের চতুর্থ দিনেও তাদের প্রিন্ট সংস্করণ বের করছে তাদের সার্কুলেশন নেমে এসেছে ১০ভাগের এক ভাগে। ভারত সরকার ২২ মার্চ জনতা কার্ফু ও তার প্রায় ৪০ঘন্টা পরে ২১দিনের লকডাউনের ঘোষনা দিলেও পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় স্তরে সচেতনতা ও রাজ্যসরকারের নির্দেশিকা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন শুরু হয়ে গিয়েছিল কার্যত ২০ তারিখ থেকেই । তবে লকডাউন থাকলেও এই দুই দিনে আঁচ পড়েনি বাংলা সংবাদপত্রের সার্কুলেশনের উপরে ।
২২তারিখ জনতা কার্ফুর দিন বা তার পরের দিন ২৩/২৪তারিখেও দৃশ্যটায় বদল আসেনি । তবে পশ্চিমবঙ্গের ছোটো বড় বাংলা থেকে হিন্দী ইংরেজি সব পত্রিকাই ধাক্কা খায় লকডাউনের শুরুর দিনেই বুধবার অর্থাৎ ২৫তারিখ । ওই দিন ছাপা পত্রিকার প্রায় ৯০শতাংশ পত্রিকাই ফিরে আসে পত্রিকা গুলির অফিসে । কার্যত এই ঘটনার পরেই শোরগোল পড়েযায় কলকাতার মিডিয়াতে। পত্রিকা গুলির সার্কুলেশনের রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকে ২৬ তারিখেও । এরপরেই জরুরি ভিত্তিতে পত্রিকার ভবিষ্যত নির্ধারণে আর্থিক ক্ষমতা অনুসারে সিদ্ধান্ত নেয় পত্রিকাগুলি।
এই সময় প্রায় সব পত্রিকাই তাদের মূল ফোকাস প্রিন্ট ভার্সন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে অনলাইন সংবাদের উপরে। তবে প্রিন্টিং খরচ ও বিজ্ঞাপনের লোকসান সামলে পাকাপাকি মুখ থুবড়ে পড়ার আগেই রাতারাতি একাধিক পত্রিকা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষনা করে তাদের প্রিন্ট ভার্সন।
বাঙ্গালির সকাল মানেই প্রতিদিন সকালে বাড়িতে ঘুম থেকে উঠেই চা সঙ্গে খবরের কাগজ। কিন্তু করনা অশান্তি থাবা বসিয়েছে বাঙ্গালির নিত্যদিনের সকালের অভ্যেসে । বাড়িতে যে কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে দিতেন, তারাই কার্যত ছুটিতে। খবরের কাগজের এজেন্টরা বলছে ছুটিতে না গিয়ে উপায় নেই কারন বাজারে পত্রিকার চাহিদা নেই , সেই সঙ্গে পত্রিকাগুলোই তাদের হাতে পৌছে দিতে পারছে না সংবাদ পত্রগুলি।
এখানেই প্রথম প্রশ্ন আসে খবরের কাগজের এজেন্ট বা বাসায় বাসায় খবরের কাগজ পৌছে দেওয়া এই মানুষগুলি কতটা সত্যি বলছে । বাস্তব বলছে একটি ৫টাকার সংবাদপত্র আপনার বাসায় পৌছে দিলে এজেন্ট ও বাসায় পত্রিকা পৌছে দেওয়া ছেলেটার কমিশন থাকে মাত্র ৫০পয়সা করে ১টাকা । মাসিক বা বাৎসরিক সাবক্রিপশনের ক্ষেত্রে কমিশনের মূল্য থাকে আরোও নগন্য। ফলে কাগজে বিক্রির পয়সায় যাদের অন্নসংস্থান তারা অবশ্যই মিথ্যে বলছে না । তাহলে গলদ কোথায় ? গলদ বা সমস্যা যে ভাবেই বলুন সেটা এই বঙ্গের সার্কুলেশন সিস্টেমে।
সে সিস্টেম জরুরি অবস্থায় ভেঙ্গে পড়েনি , যুদ্ধের সময় ভেঙ্গে পড়েনি , বঙ্গের উথাল পাতাল রাজনৈতিক সমীকরনে ভঙ্গে পড়েনি , সেই সিস্টেমের শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিয়েছে করোণা আতঙ্ক , ভেঙ্গে দিয়েছে বন্ধ ভারতীয় রেলের চাকা। প্রতিদিন সাড়ে ১৩হাজার রেল পরিচালনা করে ভারতীয় রেল । জাতীয় লকডাউনের শুরুর থেকেই রেলের চাকা বন্ধ হবার সাথে গোটা ভারতের সাথে বন্ধ হয়ছে এই পত্রিকা পরিবহনের সবথেকে সহজ , সবথেকে সস্তা ও ভারতের কোনায় কোনায় পৌছে যাবার একমাত্র সুবিধাজনক মাধ্যম। দ্বিতীয় ধাক্কাটা এসেছে অবশ্যই পত্রিকা থেকে করোনা সংক্রমনের গুজবের ভয়ে।
সকালে পত্রিকা পড়ে যে ব্যক্তিটি নিয়ম করে অফিসে বা নিত্যদিনের লোকাল ট্রেনে সহযাত্রীদের মধ্যে রাজনৈতিক ঝড় তুলতো ,সেই মানুষটিও জিও/ভোডাফোনের ফ্রি নেটের যুগে পত্রিকার থেকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ভাইরাল নিউজে বেশি বিশ্বাসী। তাই হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির ক্রমাগত পত্রিকা থেকে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর ভাইরাল গুজব সেও নিয়েছে বেশ আয়েশ করে। যার সরাসরি ইমপ্য্যক্ট পড়েছে ছোট , বড় সব পত্রিকায়।
রাতারাতি পত্রিকা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে পাঠক । পরিস্থিতি এমন সারাবছরের সাবস্ক্রিপশনের টাকা পরিশোধ করা থাকলেও পত্রিকা নিচ্ছে না সাবস্ক্রাইবার পাঠকদের ৯০শতাংশ পাঠক।
বর্তমানে পশ্চীমবঙ্গে বাংলা পত্রিকা হিসাবে নিয়মিত মুদ্রিত হয় - আনন্দবাজার , বর্তমান , প্রতিদিন , এই সময় , আজকাল , গনশক্তি, যুগশঙ্খ , কলম , একদিন , পূবের কলম , দিন দর্পণ , সুখবর , বাংলা স্টেটসম্যান , খবর ৩৬৫দিন , আর্থিক লিপি , উত্তর বঙ্গ সংবাদ, সত্যযুগ । হিন্দি সংবাদপত্র হিসাবে প্রকাশিত হয় – সন্মার্গ , প্রভাত খবর , রাজস্থান পত্রিকা , দৈনিক বিশ্বমিত্র , সালাম দুনিয়া , রাস্টিয় মহানগর , দৈনিক জাগরন , ছাপতে ছাপতে । ইংরাজি সংবাদপত্র হিসাবে প্রকাশিত হয় – টেলিগ্রাফ , টাইমস অফ ইন্ডিয়া , দ্যা এশিয়ান এইজ ,দ্যা স্টেটসম্যান , ইকোনমিক টাইমস , ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস , হিন্দুস্থান টাইমসের মত পত্রিকা।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বড় মিডিয়া গ্রুপ আনন্দবাজার, যারা আনন্দবাজারের পাশাপাশি ইংরাজি পত্রিকা দ্যা টেলিগ্রাফ মালিক । কলকাতার বাজারে বড় গোষ্টি হিসাবে পরিচিত আনন্দবাজার গ্রুপ পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত , দুরগাপুর, শিলিগুড়ি থেকে একযোগে নিয়মিত পত্রিকা ছাপার কাজ করে তা চড়িয়ে দেয় রাজ্যটির বিভিন্ন প্রান্তে । নিয়মিত ১০লক্ষের (আনন্দ বাজারের দাবি) বেশি মুদ্রিত আনন্দবাজার পত্রিকার রেল ও সড়ক পরিবহনে একযোগে সার্কুলেশন সিস্টেম ও নিজস্ব এজেন্ট ব্যবস্থা থাকলেও লকডাউনের প্রথম দুই দিনের রক্তক্ষরণ তীব্র ভাবে সয়েছে আনন্দবাজার গ্রুপ ।
ছাপার কাজ চালিয়ে যাওয়া ও নিজস্ব পরিবহনে সংবাদপত্র সার্কুলেশনের সিদ্ধান্ত নিলেও সার্কুলেশন নেমে এসেছে ১০ভাগের এক ভাগে । সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনা ছড়ায় না এই বিষয়ে পাঠক সচেতনতায় হাজারো বিজ্ঞাপন দিলেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডি ডি পুরকায়স্থ যদিও প্রতিদিনের মতই জানাচ্ছেন তারা চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না । আনন্দবাজার পত্রিকার পরেই পশ্চিমবঙ্গের দ্বীতিয় সর্বাধিক প্রচারিত প্রত্রিকা “বর্তমান” পর পর দুই দিনের ধাক্কা না নিতে পেরে তৃতীয় দিনেই বন্ধ করেছিলো প্রিন্ট সংস্করণ ।
জরুরি অবস্থায় সাদা পত্রিকা বার করা “বর্তমান” বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জোর দিয়েছিল অনলাইন সংস্করনে। যদিও রবিবার থেকে নিজস্ব পরিবহনে কলকাতা ও শহরতলীতে কিছু পত্রিকা পৌছে দেওয়ার উপরে ফের নজর দিয়েছে পরিকাটির পরিচালন পর্ষদ। তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রপের বাংলা পত্রিকা এই সময় ও তাদের ইংরাজি পত্রিকা ছাপা একেবারে বন্ধ হয়নি । বরং ধাক্কা সামলে নিজস্ব পরিবহনে পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতা , দূর্গাপুর , শিলিগুড়িসহ শহরতলীতে । দুই দিন বন্ধ রাখার পরে শহর ও শহরতলীতে পত্রিকা পৌঁছে দেবার দৌড়ে শরিক হয়েছে তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা সংবাদ প্রতিদিন, পঞ্চম স্থানে থাকা সিপিআইএমের দলীয় মুখপত্র গনশক্তি ও ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা আজকাল । দৌড়ে না থাকলেও জেলা থেকে সীমিত সংখ্যক পত্রিকা ছাপার কাজ চালাচ্ছে দৈনিক ছোটো পত্রিকা আর্থিক লিপি ্ও যুগশঙ্খ।
তালিকার প্রথম এই ছয়/সাত নাম ছাড়া স্টেটসম্যান গ্রুপের বাংলা, ইংরাজি দুই পত্রিকাই পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকার বাজারে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। পাঠক এমনিতেই নেই , অর্থ সঙ্কট তীব্র , অফিস কর্মচারী সাধারণ মানুষের হাতে পায়ের আঙ্গুলের থেকেও কম। একাধিক বার প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে এলেও কর্মচারীদের তীব্র লড়াইয়ে টিকে থাকা পত্রিকাটি অবশেষে করোনার ছোবলে ছাপার কাজ বন্ধ করে শেষের দিন গুনছে । বাকি পত্রিকাগুলির মধ্যে কলম , একদিন , পূবের কলম , দিন দর্পণ , সুখবর , খবর ৩৬৫দিন , উত্তর বঙ্গ সংবাদ, সত্যযুগ , সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ রেখেছে পরিকা ছাপার কাজ ।
হিন্দি পত্রিকার মধ্যে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছে “সন্মার্গ”। রাজ্যের হিন্দীভাষীদের মধ্যে জনপ্রিয় “সন্মার্গ” এখনো ছাপার কাজ চালু রাখলেও তা সার্কুলেটেড হচ্ছে শুধুমাত্র কলকাতা , হাওড়া ও সংলগ্ন শহরতলীর মধ্যেই । যা তাদের মোট সার্কুলেশনের মাত্র ৩০% । “সন্মার্গ” এর সাথে দৌড়ে তাল মেলাতে না পেরে বেশ কিছুদিন আগেই প্রিন্ট সংস্করন বন্ধ করেছিল দৈনিক জাগরন , এবার জাগরনের পথে হেটেছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাকি হিন্দি সংবাদ পত্র গুলোও । ইংরাজি সংবাদপত্র গুলির মধ্যে সিকিভাগ হলেও ছাপার কাজ চলছে টাইমস অফ ইন্ডিয়া , ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস , হিন্দুস্থান টাইমসের মত পত্রিকায় । তবে অনলাইন পত্রিকায় জোর দিয়েছে প্রত্যেক সংবাদ পত্রই ।
শুভজিৎ পুততুন্ড : সাংবাদিক, এশিয়া নেট নিউজ ্ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের কলকাতা প্রতিনিধি