কেন বিদেশি শিক্ষার্থী পাচ্ছে না শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ দেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা। সবশেষ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমান পরীক্ষায় বাংলাদেশের মানদণ্ডে বি গ্রেড এবং এসএটি স্কোর হিসেবে ৭০০ থাকলে তারা আবেদন করতে পারবেন।
গুচ্ছের আওতাধীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েও গত ২২ জুলাই থেকে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আবেদন করেননি বলে জানিয়েছেন ভর্তি কমিটির এক সদস্য।
কেবল চলতি ভর্তি মৌসুমেই নয়, ২০১৮-১৯ থেকে শুরু করে ২০২১-২২ পর্যন্ত চার শিক্ষাবর্ষে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি।
সবশেষ ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে সমাজকর্ম বিভাগ থেকে মাইজু আনিকা হেইক্কেন নামে ফিনল্যান্ডের এক শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর করেছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে বহু বিদেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেন। বিশেষ করে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছরেই বাংলাদেশি ডিগ্রি নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যান।
তবু কেন দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি বিদেশি শিক্ষার্থী পাচ্ছে না, কেন বিদেশিদের আগ্রহের জায়গা হতে পারছে না, এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দায় আছে কিনা; তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ভর্তি কমিটি জানিয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের যেসব কাগজপত্র প্রয়োজন সেগুলো হলো- পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি, নাগরিকত্বের সনদ, উচ্চমাধ্যমিক সমমানের পাসের সনদ এবং এসএটি’র স্কোর। এসব দলিল পাঠানোর জন্য একটি আলাদা ই-মেইল ঠিকানাও রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩-০৪ থেকে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন ১৫ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১০ জন ছিলেন নেপালের, চারজন সংযুক্ত আরব আমিরাতের এবং একজন ফিনল্যান্ডের।
টানা চার শিক্ষাবর্ষে কেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি শিক্ষার্থী টানতে পারেনি সে প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে।
শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আখতারুল ইসলাম বলেন, “একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা পড়তে আগ্রহী হয় কয়েকটি বিষয় দেখে। প্রথমত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির র্যাংকিং কেমন। এরপর তারা তথ্য জানতে চোখ রাখে ওয়েবসাইটে, সেটি যদি হালনাগাদ করা না থাকে তাহলে স্বভাবতই তারা আগ্রহ হারায়। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য যথাযথ আবাসন ব্যবস্থা আছে কিনা সেটিও তাদের দেখতে হয়।
“আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাংকিং নেই, র্যাংকিং বাড়ানোর জন্য প্রচুর কাজ করা দরকার। অফিশিয়াল হালনাগাদ ও উন্নত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে প্রচার চালানো প্রয়োজন। বিদেশিদের জন্য আলাদা আবাসনের ব্যবস্থাও করা উচিত। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হল, দূতাবাসগুলোকে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয় সম্পর্কে অবহিতও করা হয় না।”
এসবের সঙ্গে আরেকটি কারণ যুক্ত করলেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অনেকেই ফান্ডিং বা স্কলারশিপ খোঁজেন। সেটি না পাওয়াও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ।”
ভর্তি কমিটির সদস্য একজন শিক্ষক বলেন, “বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও অনেক পরিবর্তন আসছে। অনেক দেশেই উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। বাংলাদেশে পড়তে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই নেপালের। সম্প্রতি দেশটির লেখাপড়ার মানে পরিবর্তন এসেছে। ফলে বাংলাদেশে আসার আগ্রহে ভাটা পড়েছে।
“আবার জীবনযাপন ও পেশা জীবনের নানা সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত দেশগুলোয় পাড়ি জমাচ্ছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার এটিও একটি কারণ।”
একই প্রশ্নের উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ফিনল্যান্ডের নাগরিক মাইজু হেইক্কেইন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচারের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত করে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানো উচিত।”
আবাসন সংকটের প্রসঙ্গও টানলেন তিনি।
মাইজু বলেন, “আমি শুনেছি বাজেট স্বল্পতার কারণে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা হোস্টেল নেই। যদিও আমাকে ছাত্রী হলে জায়গা দেওয়া হয়েছিল।
“লেখাপড়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা আশপাশে খণ্ডকালীন চাকরিরও কোনো সুযোগ নেই। ভিসায় চাকরির অনুমোদন দেওয়া থাকে না। ফলে যারা লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করতে চান বা উপার্জন করতে চান তারা চাইলেও আসতে পারেন না।”
ভাষাগত সমস্যার কথাও বললেন তিনি। কারণ বেশিরভাগ শিক্ষকরা বাংলায় পড়ান, ক্লাস নেন। এটি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সমস্যার। আবার শিক্ষকরা নিজেদের গবেষণার কাজে শিক্ষার্থীদের তেমন সংযুক্ত করেন না, এটিকেও সমস্যা বলে মনে করেন মাইজু।
বিদেশি শিক্ষার্থী টানতে বিশেষ কোনো প্রচার চালানো হয় কিনা, জানতে চাইলে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম সেমিস্টারের ভর্তি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক স্বপন কুমার বলেন, প্রচারের ক্ষেত্রে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরন আলাদা।
“যেহেতু এটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী যেভাবে বিজ্ঞপ্তি বা কাজ করা প্রয়োজন আমরা সেভাবেই করি। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
“তবে কীভাবে ভবিষ্যতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে আমরা কাজ করব।”
বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা করা হয় জানিয়ে এই শিক্ষক বলেন, “তাদের জন্য হেল্প ডেস্ক রয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আলাদা উপকমিটি আছে, সেই কমিটিতে ১৫ জন শিক্ষক রয়েছেন। এ ছাড়া আবাসিক হলগুলোয় তাদের জন্য বিশেষ কক্ষও বরাদ্দ রয়েছে।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর প্রতিটিতে একটি থেকে দুটি কক্ষ বিদেশিদের জন্য বরাদ্দ ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থী না থাকায় কোথাও কক্ষগুলো রিডিং রুম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে আবার কোথাও সাধারণ শিক্ষার্থীরাই থাকছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবস্থান দৃঢ় করতে বিদেশি শিক্ষার্থীর বিকল্প নেই বলে মনে করেন অ্যাপ্লাইড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “গ্লোবাল র্যাংকিংয়ে ভালো করতে হলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক র্যাংকিং করার সময় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি বা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আছে কিনা; তা দেখা হয়। তাছাড়া বিদেশি শিক্ষার্থী থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির বিকাশ ঘটে, আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিতি বাড়ে।
“অপরদিকে সংস্কৃতির আদান-প্রদানও হয়। দেশ সম্পর্কে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মানুষ জানতে পারেন।”
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলেন ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থী মাইজুও।
তিনি বলেন, “শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ আমাকে নতুন অনেক কিছু শিখিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবন, বিনামূল্যের কনসার্ট, বিভিন্ন ক্লাবের কার্যক্রম, বিভাগসহ বিভিন্ন সংগঠন আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখ, ক্রীড়া সপ্তাহ, অ্যাথলেটিক্সের ইভেন্টগুলো আমার দারুণ লাগত।”
বিদেশি শিক্ষার্থী না পওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক কবির হোসেন বলেন, “কোভিড মহামারির কারণে অনেক দেশের মানুষই অর্থনৈতিক সচ্ছলতা হারিয়েছেন। সেটি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে।
“তাছাড়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে, পরীক্ষা দিতে হয়। সেটা পূর্ণ করা অনেক বিদেশি শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব হয় না।”
অবশ্য বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে জন্য ভালো বলেও উল্লেখ করলেন তিনি।
ওয়েবসাইট ক্রমান্বয়ে হালনাগাদ ও উন্নত করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থী বাড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। র্যাংকিং বাড়ানোর বিষয়েও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করব।” সূত্র; বিডি নিউজ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৫/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়