কাশ্মীর ভ্রমণ: ভূ-স্বর্গে ভিন্ন অভিজ্ঞতা (২য় পর্ব)
প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল।।
যাচ্ছিলাম পেহেলগাম। অপেক্ষায় আছি পাহাড়, ঝর্ণা আর মেঘের খেলা দেখার জন্যে। গন্তব্যের অনেক আগেই দেখতে পাচ্ছি সারি-সারি আপেল গাছ। প্রচুর আপেল ধরেছে তাতে। জানতে পারলাম, এবার চাহিদার তুলনায় অধিক আপেলের ফলন হওয়ায় ভারতের বহু প্রদেশসহ বাংলাদেশ পাকিস্তান, চায়না, মায়ানমারে এগুলো রপ্তানি করা হয়েছে। শ'দুয়েক ভেড়ার পাল পুরো রাস্তা দখল করে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে চলছে।
পড়ন্ত বিকেলে আলখেল্লা পরিহিত একজন বৃদ্ধ হাতে লাঠি নিয়ে এগুলো দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। চোখে ভেসে উঠছে ছোটবেলায় পাঠ করা আরব্য উপন্যাসের ‘দাতা হাতেম তাই’, ‘আলিফ-লায়লা কিংবা ‘রাজপুত্র ইভান’এর কাহিনী। কল্পলোকের অজানা অনাবিস্কৃত স্থানগুলো যেন আস্তে আস্তে চোখে দৃশ্যমান হতে শুরু করে।
দু'পাহাড়ের মাঝে প্রশস্ত রাস্তা। রাস্তার সমান্তরালে সরু পাথর-নদী বহমান। শত-সহস্র ভারী পাথর বয়ে নিয়ে আসা এ নদীর উৎস কোথায় তা বোঝা খুবই দুস্কর। তবে ধারনা করা হয় প্রায় ১৪ হাজার ফুট সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত চন্দনওয়ারীর কোনো এক জায়গায় এর জন্ম। লিডার-রিভার খ্যাত এ হ্রদ আপনার মন কেড়ে নিবে! এর অপরূপ সৌন্দয্য আপনাকে পাগল করে দিবে! ইচ্ছে করছে, এক্ষুনি চলন্ত গাড়ি থামিয়ে বহমান ঝর্ণার মাঝখানের ঐ ভারী পাথরটার ওপর বসে হিমশীতল জল স্পর্শ করি।
ফেরদৌসের ডাকে সম্ভিৎ ফিরে পেলে দেখি পিডিএ (পেহেল্গাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) স্বাগত জানাচ্ছে। রোড ফিনিস। এখন কি করতে হবে জানতে চাইলে ফেরদৌস জানায়, গাড়ির রাস্তা শেষ। এখন ঘোড়ার রাস্তা। ঘোড়ায় চড়তে হবে। সামনে তাকাতেই দেখি বেশ উঁচু পাহাড়, আর সমতলে অপেক্ষমাণ শত শত ঘোড়া।
পাশের সাইনবোর্ডে ট্যুর স্পট ও ট্রিপ চার্জ লেখা আছে। মোট ৮টি স্পট। মিনি সুইজারল্যান্ড-১৫২০ রুপি, পেহেলগাম ভ্যালী-১৩৫০ রুপি, কাশ্মীর ভ্যালী-১২০০ রুপি, ইত্যাদি। প্রতিজনের জন্য একটি ঘোড়া থাকছে। আমরা তিনজন। সব ক’টা স্পট দেখতে গেলে অনেক খরচের পাশাপাশি অনেক সময়ের প্রয়োজন।
হাতে সময় নেই। কারন এটা শেষ করে আমরা অন্যদিকে যাবো। সব মিলিয়ে এক একটা স্পট দেখতে ৩ ঘন্টার প্রয়োজন। আমরা মিনি সুইজারল্যান্ড, কাশ্মীর ভ্যালী ও পেহেলগাম ভ্যালী দেখবো বলে ৫০০০ রুপি দিয়ে তিনজনে ঘোড়ায় চেপে বসি। এখানে আমরা কিঞ্চিৎ প্রতারিত হয়েছি। কিভাবে? তা খানিক পড়ে বলছি। আমাদের তিনজনের জন্য তিনিটি শক্তিশালী ঘোড়া ও একজন গাইড-কাম ঘোড়া সওয়ার এ্যাসাইন করা হয়। ওর নাম আলতাফ। আলতাফের ঠোঁটের শিশের মাধ্যমে ঘোড়া তার গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রন করে। ঘোড়ার পিঠের শক্ত হ্যান্ডেলে দু’হাত ও নীচের দিকে দু’ পা রশিতে আটকে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।
তখন দুপুড় ১টা। ধারনাও করিনি যে, এত দূর্গম পথ দিয়ে ঘোড়া হেঁটে যাবে। পাহাড়ে উঠতে লাগলো ঘোড়া। আলতাফ শিশ দেয়। ঘোড়া কখনো লাফিয়ে, কখনো দৌড়ে, আবার কখনো পুরো শরীর ঘুরিয়ে পথ চলছে। কিন্তু একি! ঘোড়া পাহড়ের একদম কিনারায় যাচ্ছে কেন? এভাবে আর এক কয়েক ইঞ্চি গেলেতো নিশ্চিত পিছলে পড়ে যাবো! তখন কমপক্ষে ১০ হাজার ফিট নীচে ছিটকে পড়বো। চীৎকার করে উঠি। তাকিয়ে দেখি ঘোড়ার খুঁড়ের পাশে এক ইঞ্চি পরিমান মাটি নেই।
পা পিছলে কিংবা কোনরকম একটু স্লিপ করলে নিশ্চিত মৃত্যু! ঘোড়া ও যাত্রী কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার এর দ্বায়ভারও কেউ নিবে না। জানেনতো কাশ্মীরের ব্যাপারে ভারত সরকারের যথেষ্ট নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটলে তাদের একটাই কথা, ওখানে গেলো কেনো? মনে মনে আমি আল্লাহকে ডাকতে থাকি। চোখ বন্ধ করে রাখি। মৃত্যুকে আরেকবার খুব কাছ থেকে দেখি। নিজের ওপর ঘৃনা ধরে।
কেন এখানে এভাবে এই বয়সে ফ্যামেলি নিয়ে এত রিস্ক নিলাম? কি হতো ঘোড়ায় না উঠলে? এতটা এ্যাডভেঞ্চারের কি দরকার ছিল? পথের এ অবস্থার কথা কেউ জীবনে বলেনি। আর আমিও জানতাম না। তাই এ পথে গিয়েছি। প্রিয় পাঠক, যতটা ভয় আমরা পেয়েছি, বর্ণনায় তা তুলে ধরা সম্ভব নয়।
উঁচু পাহাড়ের কোনো এক জায়গা থেকে আলতাফের শিশে অবশেষে ঘোড়া কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং নিরাপদ রাস্তা দিয়ে পাহাড়ে উঠতে থাকে। একই পথ ধরে পিছনের দুটি ঘোড়ায় আমার স্ত্রী ও মেয়ে আসতে থাকে। দু’জন একত্রে চীৎকার করে আলতাফকে ঘোড়া থামাতে বলে। কিন্তু কোথায় আলতাফ? আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। অজানা পাহাড়ি রাস্তা, ভয় ও ঘোড়ার কান্ডে শরীর প্রায় অবশ হয়ে আসে।
এমনিতেই ঘোড়ায় বসার আসন ভীষণ শক্ত হওয়ায় হালুয়া টাইট। তারপর আবার পাহাড়ের নীচে পড়ে যাওয়ার ভয় মিলে শরীরে দারুণ নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়! কিন্তু উপায় কি? ঘোড়া অবশ্য তার নিজের খুচরো কাজটি টয়লেটের কাজ পথেই সেরেছে। আমিতো আর ঘোড়া নই। অবশেষে পাহাড়ের চূড়ায় উঠেতো চোখ ছানাবড়া! একি কান্ড!
শত শত ঘোড়া আর ট্যুরিষ্টদের পদচারনায় মুখর পাহাড়ের চূড়া। সবার চোখে বিস্ময়! এত সুন্দর কেন এ জায়গা? এটা কি তাহলে হাইওয়ে টু হ্যাভেন! ইস! সব কষ্ট যেন নিমিষেই শেষ!। অদ্ভুদ সুন্দর এই জায়গা। উঁচু-নিচু পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল এক সমতল সবুজ-প্রান্তর। চোখ ফেরানো যায়না। পাহাড়, সূর্য, মেঘ, সবুজ ঘাস, ঝরণা আর এক-সাইজের পাইন ট্রি যেনো পুরো এলাকাটিকে ভূ-স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে! রঙ্গিন চশমা খুলে ফেলি। এটি উপভোগ করতে হবে স্রেফ খালি চোখে। বড় করে দম নিই। চোখের তৃষ্ণা যেন আর মিটে না।
আপনি ছবি তোলার কথা ভুলে যাবেন। ভুলে যাবেন আপনার নিজের পথ-কষ্ট, অর্থ-কষ্ট সহ যাবতীয় সব পার্থিব ব্যাথা বেদনার কথা। জান্ডুদার রস মিষ্টি খেয়ে যেমন চোখ বন্ধ করে রাখতে হয়েছিল কিছুক্ষণ। ঠিক এমন সৌন্দর্য দেখার পর আপনা আপনি প্রশান্তিতে দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসবে। হিংসায় আপনার গা জ্বলে যাবে!। প্রকৃতির এমন রূপ সৃষ্টিকর্তা শুধু কাশ্মিরেই কেন দিলেন? এজন্যই কি এ জায়গাকে সবাই ভূ-স্বর্গ বলে!
‘মে আই টেক ইউর পিকচার, স্যার’? অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে তাকিয়ে যখন চারিদিকের শোভা দেখছিলাম, সহসা এইচডি ক্যামেরা হাতে অল্প বয়সী এক তরুনের প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বললাম। ওর নাম জহুর। আলাপকালে ওর ছবির রেট জানতে চাইলাম। প্রতি কপি ৫০ রুপি। তাও শুধু ডিজিটাল ফর্মে ডেলিভারী দিবে।
প্রিন্টেড ফর্মে ১০০ রুপি। রাজী হলাম। তবে শর্তসাপেক্ষে। স্ন্যাপ যতগুলো নেয় নিক আমি শুধুমাত্র ভালোমানের ২০টি ছবি নিবো। এবার একটার পর একটা ক্লিক চলতে থাকে। ট্রাডিশনাল কিছু পোজ দেখিয়ে দেয়। রিরক্ত হই। অনেক ছবির মাঝে যথারীতি ২০টি রেখে বাকীগুলো ডিলিট করে ওকে বিদায় করে দেই। এবার একান্তে কিছু সময় কাটাই। মাটিতে গড়াগড়ি খাই। প্রকৃতির ঘ্রাণ নিই। ক্যাবল কার, খাওয়ার দোকান এসব ঘুরে আবার ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা দিই।
ফিরতি পথে আমাদের সাথে অনেক ট্যুরিষ্ট। তারাও ব্যাক করছে। একই রাস্তা দিয়ে ফিরছি কেন? আমরাতো আরো দুটো সাইট দেখবো। আমার মেয়ে হিন্দী ভালো পারে। এটা ডরিমনের প্রভাব। এদেশে এই বয়সের বাচ্চারা এই ডরিমনের কারনেই ভালো হিন্দি পারে এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অজ্ঞাত কারনে যদিও সিরিয়ালটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। আমার মেয়ে গাইডকে জিজ্ঞেস করলো, কাশ্মীর ভ্যালী ও পেহেলগাম ভ্যালী কোথায়?
গাইড জানালো, এখন সে আমাদের সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে। মাঝপথে এসে আলতাফ দূর পাহাড়ের অপর প্রান্তে কয়েকটি ঘর-সমেত একটি গ্রামকে দেখিয়ে বলে ওটিই ‘পেহেলগাম ভ্যালী’। আমি সহ কয়েকজন ইন্ডিয়ান সম্ভবত কলকাতার কিছু ট্যুরিষ্ট অবাক হই। জানতে চাইলাম ‘কাশ্মীর ভ্যালী’ কোনদিকে? বললো এরপর আমরা সেখানেও যাবো।
কিছুদূর এসে আবার ঘোড়া থামিয়ে লিডার রিভারের ওপারের একটি গ্রাম দেখিয়ে বললো, এই যে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটি গ্রাম, এটি কাশ্মীর ভ্যালী। এবার আমি আর জিদ ধরে রাখতে পারিনি। নেমে যাই ঘোড়া থেকে। আমার দেখাদেখি অন্য কয়েকজন ভদ্রলোক ঘোড়া থেকে নেমে আলতাফকে ধমক দেয়।
কলকাতার এক দিদি বেশ ধমকের সুরে বলেই ফেললো, ‘তোমরা চিটার। কেন মিথ্যে কথা বলে এভাবে পর্যটকদের ঠকাচ্ছো। নিলে তিনটে স্পটের টিকেট। আর দেখালে কিনা মাত্র একটি। এটাই যদি করবে জানতাম, তাহলে শুধু মিনি সুইজারল্যান্ডের টিকেট নিলেই পারতাম। পথে বাকীগুলো এভাবে দূর থেকে দেখে নিতাম’।
আলতাফ হাসে। নিরুত্তর থাকে। প্রতারনার এ চিত্র শুধু কাশ্মীর নয়, ভারতজুড়ে সবগুলো ট্যুরিষ্ট স্পটে বিদ্যমান। ওদের চোখ অনেক তীক্ষ্ণ। নতুন আগন্তকরা ওদের টার্গেট। বহুদেশ বহুস্পট ঘুরে এটার প্রমান পেয়েছি যে, পর্যটনকে কেন্দ্র করে মাইক্রো-প্রফেশনালদের এক বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠে। যেখানে একজন ফটোগ্রাফার কিংবা ড্রাইভারের সাথে হোটেল, মোটেল, খাবারের দোকান, গাইড, ট্যুর অপারেটর, শপিং মল, মসলার দোকান, মোবাইল সিম বিক্রেতাসহ পুরো ভ্রমণে তারা আপনাকে শুধুমাত্র তাদের নেটওয়ার্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়।
এদের দৌরাত্মকে উপেক্ষা করা সহজ নয়। এরকম মাইক্রো-প্রফেশলানদের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলোঃ গাইড, ফটোগ্রাফার, স্থানীয় লোকজন, পোশাক ভাড়ার শপ, হোটেল, মোটেলের কর্মচারী, খাবার ও খেলনা বিক্রেতা, ঘোড়া ও গাড়ির চালক, সিম বিক্রেতা। তাদের ব্যবসা নিয়ে আমার কোনো কমপ্লেইন নেই। কমপ্লেইন শুধু ভুল তথ্য দিয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে অধিক অর্থ খসানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি দুই সপ্তাহ ভারত ভ্রমণ করে এমন অভিজ্ঞতাই আমার হয়েছে।
আমার দেখা স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোঃ কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের ডাললেক, নিষাদ গার্ডেন, শালিমার গার্ডেন, হযরত-এ-বাল মসজিদ, শিকারা, সেফ্রান, পেহেলগাম, মিনি সুইজারল্যান্ড, লিডার রিভার, চন্দনওয়ারী, বেতাব ভ্যালী, আরুন ভ্যালী। দিল্লীর কুতুব মিনার, ইন্ডিয়া গেইট, লোটাস ট্যাম্পেল, যন্তর-মন্তর, লাল কেল্লা। আগ্রার তাজমহল, ফতেহপুর সিরকি ও তাজমহল। এ সব এলাকা ঘুরে আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ‘ট্যুরিজম ও চিটিজম’ এ দুটি প্রায় সমার্থক শব্দ এবং দুটোই যুগপৎভাবে ঘটে।
বিশেষ করে ভারতে এটা দেখার জন্য খুব যে বড় কোনো সরকারী প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান আছে, অবস্থাদৃষ্টে আমার তা মনে হয়নি। তারপরও লাখো পর্যটক শুধুমাত্র ভারতেই কেন ঘুরতে যায়? উত্তর একটাই, তাহলো ভূ-ভারত ঘুরে দেখলে আর বিশ্ব ঘুরে দেখার দরকার হয়না। এটি ঐতিহাসিকভাবে এবং ঐতিহ্যগতভাবে চির সত্য।
[কোন অমোঘ আকর্ষণে দেশ-বিদেশের পর্যটকগন ছুটে আসেন তাজমহলে? কেন একবার এই সৌধ না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়? কেন ফতেপুর সিক্রির ইতিহাস রূপকথার কল্পকাহিনী হয়ে আজো মানুষের হৃদইয়ে দোলা দেয়? ইতিহাসের আলোকে যুক্তি-তর্কসহ লেখকের মতামত জানতে চোখ রাখুন আগামী পর্বে।]
লেখক:
প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল
ডীন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়