কাল থেকে লকডাউন
নিউজ ডেস্ক।।
ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে করোনা মহামারী (কোভিড-১৯)। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আপাতত সাত দিনের লকডাউনে যাচ্ছে সরকার। আগামীকাল সোমবার থেকে এই লকডাউন শুরু হবে। এটি বাড়ানো হবে কিনা, বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে জানান তিনি।
দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। গত বছরের মার্চের শুরুতে রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগ এলাকা প্রথম ‘লকডাউন’ করা হয়েছিল। ঢাকাসহ সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপরও এলাকাভিত্তিক লকডাউনের অংশ হিসেবে দুই থেকে তিন সপ্তাহ অবরুদ্ধ রাখা হয়েছিল ঢাকার রাজাবাজার ও ওয়ারীসহ কয়েকটি এলাকা। ঢাকাসহ করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়া বিভিন্ন এলাকা জোনভিত্তিক লকডাউনের চিন্তা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তখন তা আর হয়নি।
গত ২৯ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুনরায় বেড়ে যাওয়ায় জরুরি সেবাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সব অফিস ও কারখানা অর্ধেক জনবল দিয়ে পরিচালনা করা, জনসমাগম সীমিত করা, গণপরিবহনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনসহ ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এরপরও সংক্রমণ বেড়ে চলায় কাল থেকে লকডাউনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে লকডাউনের গতি-প্রকৃতি কেমন হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রজ্ঞাপন জারির পরেই বিস্তারিত জানা যাবে।
এক সপ্তাহের লকডাউন প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আপাতত সাত দিন লকডাউন দিচ্ছি। আশা করছি, এই সাত দিন মানুষকে ঘরের মধ্যে রাখতে পারলে সংক্রমণ রোধ করতে পারব। না হয় সংক্রমণ আরো ছড়িয়ে যাবে। মানুষের নানা বিষয় আছে, সেগুলো সাত দিন লকডাউনের শেষের দিকে বিবেচনা করব, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেব। আপাতত সাত দিন থাকবে।’
এর আগে লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষদের জন্য বিভিন্ন রকমের সহায়তার ব্যবস্থা ছিল। এবার কী হবে? এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘লকডাউন সাত দিনের জন্য সংক্ষিপ্ত হলে সেগুলো নিয়েও চিন্তাভাবনা থাকছে। প্রজ্ঞাপন যখন দেয়া হবে, তখন বিস্তারিত থাকবে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যার পর প্রজ্ঞাপন হওয়ার কথা।’ তবে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল সকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে যখন এক সপ্তাহ লকডাউন দেয়ার কথা বলেন, তখন থেকেই দেশজুড়ে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে এই লকডাউনটা কেমন হবে, এলাকাভিত্তিক নাকি পুরো দেশ? এটি এখনো স্পষ্ট হয়নি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সোমবার থেকে এক সপ্তাহের ‘লকডাউন’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, লকডাউন চলাকালে শুধু জরুরি সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। আর শিল্প কলকারখানা খোলা থাকবে, যাতে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন শিফটে কাজ করতে পারে। জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের চলাফেরা যাতে কমাতে পারি সেজন্য আমরা আপাতত এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন দিচ্ছি। আমাদের জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান, ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস, ফায়ার সার্ভিসের অফিস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অফিস, সংবাদপত্র অফিস এই ধরনের অফিস খোলা থাকবে।’
তিনি বলেন, লকডাউনের মধ্যে শিল্পকারখানা খোলা থাকবে, সেখানে একাধিক শিফট করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে শ্রমিকরা কাজ করে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে তো আবার গত বছরের মতো শ্রমিকদের বাড়ি যাওয়ার ঢল শুরু হয়ে যাবে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। সব ধরনের মার্কেট বন্ধ থাকবে।
গণপরিবহন বন্ধ থাকবে কিনা জানতে চাইলে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা যখন এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করব সেখানে তা স্পষ্ট করে বলা হবে। এখনই এ বিষয়ে বলছি না।’ প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘মানুষের চলাচল যাতে একেবারে সীমিত করে ফেলা যায় আমরা সেই পদক্ষেপ নেব। কেউ অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে পারবে না।’ অনেক লোক বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আটকে থাকতে পারে, তাদের সেই সুযোগটা দিয়ে একদিন পর লকডাউন দেয়া হচ্ছে বলেও জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী।
দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত বছর ২৩ মার্চ প্রথমবার সাধারণ ছুটির ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। শুরুতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি দেয়ার পর মেয়াদ বাড়ানো হয় কয়েক দফা। ওই সময় সব অফিস আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ছুটির মধ্যে সব কিছু বন্ধ থাকার সেই পরিস্থিতি ‘লকডাউন’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
লকডাউন কেমন হতে পারে সেই প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে মানুষ মনে করে ছুটি হয়েছে, ঘুরতে চলে যায়। এ কারণে এবার লকডাউন দেয়া হয়েছে। সবাইকে ঘরে থাকতে হবে।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সংক্রমণ বাড়তে থাকায় জাতীয় কমিটির পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আংশিক লকডাউনের পাশাপাশি পুরো লকডাউনের সুপারিশও ছিল। সংক্রমণ পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে গেলে লকডাউন দেয়ার চিন্তা সরকারের আগেই ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমে ১৮ দফা যে প্রস্তাব করা হয়েছিল তা অনেক ভেবেচিন্তে, অনেকের পরামর্শ নিয়ে করা হয়েছে। সরকার শুরুতে সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেনি। এখন আস্তে আস্তে কঠোর হচ্ছে।’
কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, অতিরিক্ত ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় লকডাউনের ব্যাপারে তারাও সুপারিশ করেছিলেন। তবে তা দেশজুড়ে করার প্রস্তাব ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১৮ দফা প্রস্তাবের একটা ছিল কিছু এলাকায় আংশিক লকডাউন। আমরা বলেছিলাম হয় আংশিক, নয় মোডিফাইড লকডাউন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যদি কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে ওই ব্যক্তির পুরো বাড়ি বা ফ্ল্যাটকে দুই সপ্তাহের জন্য লকডাউন করে ফেলা। এই সময় বাইরের সাথে মেলামেশা পুরো বন্ধ রাখতে হবে। তাদের দৈনিক প্রয়োজন বাইরে থেকে মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটাকে তারা মোডিফাইড লকডাউন বলছেন।
গত বছরের ৩০ নভেম্বর থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগী কমতে শুরু করে, পাশাপাশি কমে সংক্রমণের হারও। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২৯১ জনের করোনা শনাক্ত হয়। পরে আবার বাড়তে শুরু করে সংক্রমণ। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাত্রা অনেক বাড়তে থাকে। ২৩ মার্চ তা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ২৯ মার্চ থেকে টানা তিন দিন দৈনিক শনাক্ত ৫ হাজারের বেশি হয়। ১ ও ২ এপ্রিল ৬ হাজারের ঘর ছাড়ায়। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৮৩ জনের। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৫৮ জন। দেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ছয় লাখ ৩০ হাজার ২৭৭ জন। মারা গেছে ৯ হাজার ২১৩ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছে পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৫ জন।