বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে যুগোপযোগী পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবর্ধন,পরিমার্জন,সংশোধন,সংযোজন ও বিয়োজন অনেক কার্যক্রম চলছে শিক্ষাক্ষেত্রে। শিক্ষাক্ষেত্রে ইতোমধ্যে যে সাহসী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা আগে কোনো সরকার নিতে পারেননি। নিয়োগে স্বচ্ছতা,দুর্ণীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধে কমিটির ক্ষমতা খর্ব করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এনটিআরসিএ'র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী ও অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ। যদিও প্রতিষ্ঠান প্রধান,সহকারী প্রধান ও অফিস সহায়ক নিয়োগের ক্ষমতা এখনো কমিটির হাতে। এসব পদে নিয়োগের জন্য প্রচুর টাকার লেনদেনের খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার হয়। সরকার পিএসসির আদলে আলাদা কমিশন গঠন করে এসব পদে নিয়োগের চিন্তা করছেন। এসব চিন্তাও সময়োপযোগী। প্রতিষ্ঠান প্রধান সৎ ও দক্ষ না হলে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়না। দেরিতে হলেও এ বিষয়টি পরিস্কার। এজন্যই পিএসসি’র আদলে বা আলাদা কমিশন গঠন করে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারী প্রধান নিয়োগের যে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন সরকার; তাকে সাধুবাদ জানাই।
বেসরকারি রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো একসাথে জাতীয়করণও প্রাথমিক শিক্ষায় আরেকটি সাহসী পদক্ষেপ। বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই বিতরণ শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আরেকটি সাফল্য।
শিক্ষাক্ষেত্রে সময়োপযোগী বহু সিদ্ধান্তের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে সরকারের আন্তরিকতাও আরেকটি বড় উদাহরণ। প্রতি উপজেলায় একটি টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপন ও ২০২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্তিও কারিগরি শিক্ষা প্রসারে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল কোর্স চালু করে কারিগরি শিক্ষাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকারের মহতি উদ্যোগ বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন কারিগরি শাখার শিক্ষক কর্মচারীরা। কিন্তু তারা আজও আছেন এ্যানালগ পদ্ধতিতে। সাধারণ শাখার শিক্ষক কর্মচারী ও অভিভাবকদের অভিযোগ কারিগরি শাখা এখনও এনালগ রয়ে গেছে। তারা বলেন যেখানে টেকনিক্যাল শাখা আধুনিক ও সবার আগে সব বিষয়ে আমাদের ( সাধারণ শাখা) চেয়ে এগিয়ে থাকার কথা সেখানে তারা অনেক পিছিয়ে। কারিগরি শাখার শিক্ষক মো. জাফর ইকবাল বলেন, আমাদের শাখার কর্তা ব্যক্তিরা অতি চালাক। তারা সরকারকে খুশি রাখার জন্য অতি উৎসাহী হয়ে কর্তণের আগেই কেটে ফেলে আমাদের টাকা। তিনি মজা করে বলেন অবশ্য আবার ফেরতও দিয়েছেন পরে। আমার কথা হলো এই অতি উৎসাহী লোকজন আজ কোথায়?
কারিগরি শাখার এমপিও কার্যক্রম এখনো সেই আগের মতো রয়ে গেছে। অথচ সাধারণ শাখা ও মাদরাসা শাখার এমপিও সেল( ইএমআইএস) অনেক আধুনিক। সাধারণ শাখায় একজন শিক্ষকের বেতন সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র প্রতিষ্ঠানে বসেই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর অনলাইনে পাঠানো হয়। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ইএমআইএস সেলে যেতে কোনো তদবির বা মাধ্যমের প্রয়োজন হয়না। কোনো হার্ডকপি সংরক্ষণ এবং পরবর্তীতে তা ঢাকায় পাঠানোর প্রয়োজন হয়না। অনলাইন পদ্ধতির সকল ধাপই অনুসরণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর। তাহলে কারিগরি কেনো এখনো এ্যানালগ? কথাগুলো যুক্তিসহকারে বললেন সহকারী প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র মন্ডল।
কারিগরি শাখার এমপিও পেতে বা স্কেল সংক্রান্ত কোনো কাজে এখনো ম্যানুয়াল পদ্ধতি রয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সহজ বিষয়ের সাথে কিছু জটিল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সেই আগের নিয়মে হাতে হাতে কাগজপত্র জমা দিতে যেতে হয় ঢাকার ডিজি অফিসে। ২য় উচ্চতর স্কেল পেতে চাকরির শুরু থেকে বছরে ২ টি এমপিও কপি সংযুক্তকরণ,নিয়োগ পরীক্ষার কাগজপত্র সহ নানাবিধ কাগজ চাওয়া হয়। এসব কাগজের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। যে ব্যক্তি টাইম স্কেল পেয়েছে পুনরায় উচ্চতর স্কেল পেতে ২য়বার এতো কাগজ কতোটুকু গুরুত্ব বহন করে? কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কার্যক্রমও চলছে কচ্ছপ গতিতে। উচ্চতর স্কেল সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন এনালগ পদ্ধতি অনুসরণ করে কারিগরি অধিদপ্তরের চাহিদামত কাগজপত্র জমা দিয়েও অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। কাগজপত্র সঠিকভাবে পৌছলো কিনা সে বিষয়েও টেনশন থেকেই যায়। এই কাগজ নাই,ঐটা নাই আরো কতো কি। এটা নেই, সেটা নেই এসবতো আছেই।
বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে সমস্যার শেষ নেই। শিক্ষক প্রশিক্ষণ নেই, কাচামালের অভাবে ব্যবহারিক ক্লাস নেই, পর্যাপ্ত শ্রেণি কক্ষ নেই, ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য আলাদা কক্ষ নেই, শিক্ষক-কর্মচারীদের উচ্চতর স্কেলের সুখবর নেই।
বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন না হলে শিক্ষার আসল ভিত্তি নড়বড়ে থেকে যায়। সরকারের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। তেমনি কারিগরি শিক্ষার অভাবে অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে গেলে রেমিট্যান্স কম আসে। দেশেও কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায়। ফলে দেশ মধ্যম আয়ের দেশে রুপান্তরিত হতে সময় নেয়। কারিগরি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকগন সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করলে অল্পতেই কাংখিত লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব। যেখানে টেকনিক্যাল শাখা আধুনিক হওয়া প্রয়োজন সেখানে তারা এখনো এনালগ। সাধারণ জনগন মনে করে সরকার যেখানে টেকনিক্যাল বা কারিগরি শিক্ষার প্রতি আন্তরিক সেখানে কাজকর্মে পিছিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিগণ। কারিগরির সকল কিছু সাধারণ শাখা ও মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড এবং অধিদপ্তরের কাজের চেয়ে পিছিয়ে। সাধারণ শাখায় প্রথম সপ্তাহে এমপিও ছাড় হলেও কারিগরি শাখায় হয় দ্বিতীয় সপ্তাহে। আর সরকারি চাকরিজীবীরা বেতন পান মাসের শুরুতেই। সকল শিক্ষক -কর্মচারীর বেতন সপ্তাহের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পাওয়া উচিত। কারিগরি শাখার জনবল সাধারণ শাখার তুলনায় অনেক কম। অথচ সাধারণ শাখায় ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার( ইএফটির) প্রাথমিক কার্যক্রম শেষ হলেও কারিগরি শাখায় শুরুর কোনো খবর নেই। কারিগরি শাখার নীতিনির্ধারক ও কর্তাব্যক্তিগণ সঠিক পদক্ষেপ এবং আন্তরিকতার পরিচয় দিয়ে এ শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে যথাযথ ভূমিকা রাখবেন এবং শিক্ষক কর্মচারীদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় যুগোপযোগি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এ প্রত্যাশা সকলের। সাধারণ শাখা, মাদরাসা কিংবা কারিগরি শাখার সুবিধা -অসুবিধার তুলনা করা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। বেসরকারি সকল শিক্ষক সমাজ অবহেলিত এটা সর্বজন স্বীকৃত। কিছুদিন আগেও ফেসবুকে ঝড় ওঠেছিল মুজিব বর্ষের উপহার স্বরুপ বেসরকারি শিক্ষকদের শতভাগ ঈদ বোনাস দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের নেতারাও তাদের ফেসবুকে সরকারের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ভাইরাল হয়েছিল। পরে জানা গেলো শিক্ষকদের অবস্থার বিন্দু পরিমান উন্নতি হয়নি। সেই ১৭ বছর আগের শিকিআনা বোনাস নিয়েই তাদের তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। এতো উন্নয়নের মাঝে শিক্ষকদের বোনাস ২৫% থেকে ১০০% আশা করাটা খুব বেশি চাওয়া নয়। এটা শিক্ষকদের অধিকার। না পাওয়া তাদের প্রতি অন্যায়।
অবহেলিত শিক্ষক সমাজ অল্পতেই তুষ্ট। সরকারি কোষাগার থেকে বেতন- ভাতা নিয়ে শুধু বেসরকারি শিক্ষক সমাজ ছাড়া অন্য কেউ কখনো ডাক- ঢোল পিটিয়ে আনন্দ র্যালী করে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাস্তায় আনন্দ মিছিল করার ইতিহাস নেই। শিক্ষক সমাজ এখনো আশা করে সামনের ঈদ বোনাস শতভাগ পাবেন তারা। জাতীয়করণ ঘোষণা না হলেও ঈদ বোনাস শতভাগ পাওয়ার আশা খুব বেশি আশা নয়।
বর্তমান সরকারের কর্ণধার,জাতির পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরী, শিক্ষায় যুগোপযোগী উন্নয়ন ও পরিবর্তনের পরিচালক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পুরস্কার ঃ প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন,শান্তি বৃক্ষ, সাউথ সাউথ, মাদার তেরেসা,হুপে বোটানি,গ্লোবাল ডাইভার্সিটি, গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশীপ সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বেসরকারি শিক্ষক সমাজের প্রাণের দাবী বেসরকারি রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো একসাথে "জাতীয়করণ" না হলেও সরকারি নিয়মে বদলী,বাড়িভাড়া, চিকিৎসা সহ বিভিন্ন ভাতা পাওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় সম্মতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের এই ন্যায্য দাবী প্রদান করা হোক মুজিব বর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার।
বিন-ই-আমিন
শিক্ষক
নলছিটি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ
ঝালকাঠি ও সহকারী সম্পাদক, শিক্ষাবার্তা ডটকম