কলেজ সরকারিকরণে অসংগতি ও কাজে দীর্ঘসূত্রিতা
মো. শরীফ উদ্দিন।।
শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনকারী মাদার অফ হিউম্যানিটি খ্যাত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো যুগোপযোগী ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কলেজ ও একটি করে স্কুল সরকারিকরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষণা অনুযায়ী ২০১৬ সাল থেকেই এর কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে এ সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আরো ৪৫ টি কলেজের সরকারিকরণের যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করে। এরপর শুরু হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ। এ লক্ষ্যে প্রথম দিকে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের তালিকাভুক্ত করে নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন থেকে ১৯৯ টি কলেজের উপর নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা জারি করে জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত করা হয়। পর্যায়ক্রমে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এ তালিকায় যোগ হয়। নিষেধাজ্ঞা জারির পর কলেজগুলোকে আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিদর্শনের কাজ সম্পন্ন করা হয়। পরিদর্শনের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রথমবারের মতো কলেজের শিক্ষক কর্মচারীদের যাবতীয় মূল কাগজপত্র যাচাই বাছাই করেন। এর সাথে সাথে কলেজের যাবতীয় হিসাব নিকাশ শেষ করেন তারা। এক পর্যায়ে কলেজগুলোর দানপত্র দলিল (Deed Of Gift) হস্তান্তর এর কাজ সম্পন্ন হয়।
সবশেষে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট ২৭১ টি কলেজকে একসাথে সরকারিকরণের প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। প্রজ্ঞাপনে ৮ আগস্ট থেকে সরকারিকরণ কার্যকর হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এরপর আরো কিছু কলেজ সরকারিকরণের আওতায় এনে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। শুরু হয় পদ সৃজনের কাজ। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাউশিকে পদ সৃজনের কাজ সম্পন্ন করার জন্য তাগাদা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এ বছরেরই ১৪ অক্টোবর সমন্বিত পদ সৃজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এরপর চলে যায় আরো প্রায় অর্ধ বছর। অবশেষে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ২০টি কলেজেকে পদ সৃজনের জন্য নির্ধারিত ক,খ এবং গ ছক অনুসারে প্রস্তাব পাঠানোর জন্য মাউশি থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এ বছরের ৫ এপ্রিল বাকি কলেজগুলোকে তিনটি তালিকায় বিভক্ত করে পর্যায়ক্রমে পদ সৃজনের প্রস্তাব পাঠানোর জন্য বলা হয়। এ কার্যক্রম শেষ করার পর শুরু হয় মূল কাগজপত্র আবার দ্বিতীয়বারের মতো মাউশিতে পরিদর্শনের কাজ। এখনো তা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে জানলাম ৮টি কলেজের পদ সৃজনের জন্য আবার সেসব কলেজের অধ্যক্ষদের নিয়ে গত ২৪ আগস্ট একটি মিটিং হয়। মিটিং এ তৃতীয়বারের মতো আবার মূল কাগজপত্র দেখানো হয়। কিন্তু এ ৮টি কলেজের তালিকায় প্রথম ২০টি থেকে রয়েছে মাত্র একটি। প্রশ্ন হলো, পদ সৃজনের মতো এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি এত অগোছালোভাবে করা হচ্ছে কেন? আর যদি সুশৃংখলভাবে করাই হতো তাহলে প্রথম ২০টি কলেজ থেকেই থাকার কথা ছিল সেগুলো নাই কেন? তাছাড়া ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর সমন্বিত পদ সৃজনের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এর বাস্তবায়ন কোথায়? একই কাগজপত্র আর কয়বার দেখাতে হবে?
আরো কিছু অসঙ্গতি রয়েছে যা পদ সৃজনের কাজকে দীর্ঘায়িত করবে বলেই মনে করি! যেমন এমপিওভুক্তিতে স্মারক নম্বর কখনোই লাগেনি। অনেক পুরনো প্রতিষ্ঠানে সেগুলো সেভাবে যত্ন করে রাখাও হয়নি। কিন্তু শিক্ষকদের মূল কাগজপত্রের সাথে স্মারক বই দেখাতে হয়। ডিজি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মনোনয়নের চিঠিও অনেক কলেজে সেভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে পারেনি। অনেক পুরোনো প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো ৩০/৪০ বছর আগেই বিষয় অধিভুক্তি হয় কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ সেগুলো সংরক্ষণ করতে পারেনি বা হারিয়ে গিয়েছে। এসব অধিভুক্তি নবায়ন এর কাগজ রয়েছে কিন্তু এখানে চাওয়া হচ্ছে মূল কাগজ। নবায়নের কাগজপত্র যদি থাকে তাহলে মূল কাগজগুলো অবশ্যই ছিল, না হয় সেগুলো নবায়ন হলো কিভাবে? এসব বিষয়গুলোকে পদ সৃজনের জন্য প্রতিবন্ধকতার পরিচায়ক হিসেবেই মনে করি।
মূল সার্টিফিকেট নিয়ে কিছু কথা বলতেই চাই। মূল সার্টিফিকেট যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আমি মনে করি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু তাঁরা একটু সন্দেহ হলেই যাচাইয়ের জন্য প্রত্যয়নপত্র দিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়ে দেন। এতে করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণকে নতুন করে ঝামেলায় পড়তে হয়। কিন্তু সনদপত্র কর্মকর্তাদের কাছে যাচাইয়ের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি কেন? আবার যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির অনার্সের সার্টিফিকেট পাতলা এবং মাস্টার্সের সার্টিফিকেট ভারী কেন যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে সেটি নিতান্ত হাস্যকরই বটে! কথাগুলো আমি আমাদের কলেজের কাগজপত্র প্রদর্শনের সময় উপস্থিত থেকে সঞ্চিত বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
এসব কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলে মনে করছি। যে উদ্দেশ্য নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারিকরণের কাজে হাত দিয়েছিলেন তা এখনো অধরাই থেকে গেছে। ছাত্রছাত্রীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। অনেক ছাত্রছাত্রী সরকারি কলেজ সাইনবোর্ড লেখা দেখে ভর্তি হয়ে বেসরকারি আমলের টাকা পরিশোধ করতে যেয়ে বিপাকে পড়ছে। অনেক কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আবার আন্দোলনও করছে যা খুবই যৌক্তিক বলে মনে করি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা থাকায় পাঠদান কর্মসূচি ব্যহত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। ২০১৬ সালে এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে অনেক শিক্ষকের চাকরি শেষ হয়ে গিয়েছে! অনেকেরই শেষ হওয়ার পথে! আবার অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন! যা খুবই দুঃখজন। এসব জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে জটিল বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততর সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা এখন সময়ের দাবি।