কলাগাছের শহিদ মিনারে শিশুদের শ্রদ্ধা
ঝালকাঠিঃ তিনটি কলাগাছ দাঁড় করিয়ে ইট দিয়ে সিঁড়ি তৈরি করেছে শিশুরা। তাতে রঙিন কাগজ কেটে সুসজ্জিত করে ফুল ছিটিয়ে দিয়েছে। সুরক্ষিত রাখার জন্য চতুর্দিকে খুঁটি বসিয়ে ফিতায় রঙিন কাগজ কেটে ঝুলিয়ে দিয়েছে। প্রবেশদ্বারে জাতীয় পতাকার প্রতীকী অনুসারে কাগজের ছোট পতাকা ঝুলিয়ে দিয়েছে। খুবই সুসজ্জিত করে মহান শহিদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে শিশুরা। ঝালকাঠি শহরের উত্তর দিকে বিকনা এলাকায় এভাবেই দিবসটি উদযাপন করে শিশুরা।
ওই এলাকার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র জুবায়ের, শিশু শ্রেণির তাওহীদ, প্রথম শ্রেণির আবির, পঞ্চম শ্রেণির শাকিল এবং ৬ বছর বয়সী রাব্বি উদযাপন করছে। দিবসটি সম্পর্কে তাদের ধারণাও প্রাথমিক পর্যায়ে। প্রত্যেকেই দিবসটি সম্পর্কে আলাদা বর্ণনা দিলেও মূল কথা একই।
শুধু বিকনাতেই না, ঝালকাঠির প্রত্যন্ত এলাকায় কয়েক হাজার অস্থায়ী শহিদ মিনার তৈরি করে শিশু-কিশোররা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। প্রত্যন্ত এলাকায় শহিদ মিনার না থাকায় স্থানীয় কচিকাঁচা শিশু-কিশোররা কলাগাছের তৈরি শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। অভিভাবকদের কাছে অমর একুশের ভাষা আন্দোলনের গল্প শুনে ও বই পড়ে মাতৃভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভাষা শহিদদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এই শ্রদ্ধা নিবেদন করে শিশুরা।
জেলার প্রত্যন্ত এলাকার অধিকাংশ প্রাথমিক স্কুল ও মাদরাসায় শহিদ মিনার নেই। এক স্কুল থেকে অন্য স্কুল তো অনেকটাই দূরে অবস্থিত। আবার সব স্কুলে শহিদ মিনার নেই। তাই স্ব স্ব স্থানীয় শিশুরা বাড়ির উঠানে মাটি দিয়ে উঁচু করে কলাগাছ পুঁতে শহিদ মিনার তৈরি করেছে। শিশু থেকে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী এসব শিশু-কিশোরদের বয়স ৬-১৫ বছর। শহিদ মিনার তৈরিতে তারা প্রথমে কাঁদামাটি, কলাগাছ, বাঁশের কঞ্চি ও রঙিন কাগজের ব্যবহার করেছে।
প্রতিটি মিনারের ওপর অপেক্ষাকৃত ছোট কলাগাছের আরো তিনটি টুকরা তির্যকভাবে আটকে দেওয়া হয়েছে। রঙিন কাগজ ও নানা রঙের ফুল দিয়ে প্রতিটি মিনার মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে সুতা টানিয়ে তাতে রঙিন কাগজ ও বেলুন দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। শহিদ বেদিতে বুনোফুল ছাড়াও কিছু গাঁদা ও গোলাপ ফুলও দেওয়া হয়েছে। পাশেই সাউন্ড সিস্টেমে দেশাত্মবোধক গান বাঁজানো হচ্ছে। কয়েকটি জায়গায় আবার ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শেষে শিশুরা খাবারের আয়োজনও করেছে।
শিশু-কিশোররা জানায়, অভিভাবকদের কাছ থেকে অমর একুশের ভাষা আন্দোলনের গল্প শুনে ও বই পড়ে শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তাছাড়া প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রভাত ফেরি নিয়ে অভিভাবকদের শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে দেখে তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছে। ইটের তৈরি শহিদ মিনারে বড়দের শ্রদ্ধা জানাতে দেখে তারা বাড়ির আঙিনা বা পতিত জমিতে কলাগাছের প্রতীকী শহিদ মিনার তৈরি করে নিজেরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছে। কেউ বাড়ির গাছের ফুল দিয়ে আবার কেউ মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফুল কিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে।
শিশু শিক্ষার্থী মারুফ মিয়া, রকিবুল, ফরিদ, বেল্লাল, সায়মা, রাতুলসহ অনেকেই উৎসাহের সঙ্গে জানায়, ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় এলেই তারা অভিভাবকদের কাছ থেকে শহিদ দিবসের কথা শুনতে থাকে। বই পড়ে তারা ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে শিক্ষকদের কাছ থেকে দিবসটির তাৎপর্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পরিকল্পনা করে। তারা কয়েকজন মিলে কীভাবে শহিদ মিনার বানানো যায়, কোথায় ফুল পাওয়া যাবে, কে কে তাদের কাজে সহযোগিতা করবেন, এসব বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত ও বড়দের সহযোগিতা নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা কাজ শুরু করে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে পাড়ার ছেলে-মেয়েরা মিলে মিশে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম জানায়, বাবা-মা আর স্কুলের বড় ভাইদের কাছ থেকে সে একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে জেনেছি। কীভাবে শহিদ মিনার তৈরি করা যায় ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয় সেটাও তাদের জানা থাকায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছি।
মো. কবির মিয়া জানায়, তাদের মধ্যে কেউ নিজের বাড়ির ফুল আবার অনেকেই শহর থেকে ফুল কিনে এনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাদের ভালোই লাগে।
সায়মা আক্তার জানায়, সে জানতে পেরেছে বাংলা ভাষার জন্য রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতসহ অনেকেই শহিদ হয়েছেন। তাদের সম্মানে সকালে ফুল দিয়ে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে ও তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনাও করে তারা।
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাকিব মিয়া জানান, তাদের গ্রামে কোন স্থায়ী শহিদ মিনার না থাকায় সকালে শিশু-কিশোরদের নিজেদের তৈরি কলা গাছের শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে দেখে তিনি আপ্লুত হয়েছেন। গ্রামে যে ফুল পাওয়া সেই ফুল দিয়েই তারা শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। কেউ কেউ শহর থেকে ফুল কিনে এনেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজনের) জেলা শাখার সহ-সভাপতি বাদল মাহমুদ বলেন, নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো দিক। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের শিশু-কিলোররা অন্তত এটা বুঝতে পেরেছে ২১ ফেব্রুয়ারি কিছু একটা হয়েছিল। সেজন্য বড়দের অনুকরণে কোমলমতি শিশুরা কলা গাছ দিয়ে শহিদ মিনার তৈরি করে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। এটাকে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিয়ে তাদের কাছে অমর একুশের মূল তাৎপর্যটা তুলে ধরতে পারি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২১/০২/২০২৪