করোনায় দৃষ্টিত্রুটির সমস্যায় শিক্ষার্থী
দৃষ্টিত্রুটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২ মিলিয়ন শিশু দৃষ্টিত্রুটির সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশেও এটি উদ্বেগের। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশে স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ১৪ জনের দৃষ্টিত্রুটি রয়েছে। এ হার সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকায়, প্রায় ৪০ শতাংশ। ভীতিপ্রদ তথ্য বৈকি।
অনেক দেশেই অন্ধত্ব ও শিশুর দৃষ্টি বৈকল্যের অন্যতম প্রধান অনুঘটক হলো দৃষ্টিত্রুটি। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও চিত্রটি খুব একটা ভিন্নতর নয়। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ সমস্যা আরো প্রকট হচ্ছে। দেশে বেড়ে চলা দৃষ্টিত্রুটির পেছনে বেশ কিছু কারণ বিদ্যমান। এক্ষেত্রে জিনগত কারণ যেমন আছে, তেমনি অভ্যাসগত কারণও আছে। জিনগতভাবেই অনেক শিশুর দৃষ্টিত্রুটি থাকে। চোখের গঠনগত ত্রুটির জন্য অনেক সময় এমনটি হয়। চিকিৎসা পরিভাষায় এটিকে বলা হয় ‘লেজি আই’ বা দুর্বল চোখ। দুর্বল চোখের কারণে শিশু কম দেখতে পারে। আছে পুষ্টিহীনতার ইস্যুও। দৃষ্টিশক্তির জন্য ভিটামিন এ অপরিহার্য উপাদান। প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব কিংবা দরিদ্রতার কারণে বিকাশকালীন অনেক শিশুর খাবারে ভিটামিন এ-র ঘাটতি ঘটে। পরবর্তী সময়ে এটা দৃষ্টিশক্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সবকিছু ছাপিয়ে এখন শিশুর দৃষ্টিত্রুটির সমস্যায় বড় ভূমিকা রাখছে জীবনযাত্রার রূপান্তর। বিশেষত শহরে শিশুদের জন্য খেলাধুলার সুযোগ অনেক সীমিত। পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই। যেগুলো আছে তাও ক্রমসংকুচিত। এ অবস্থায় শিশুরা দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ অত্যাধুনিক মুঠোফোনের স্ক্রিনে। অনেক অভিভাবকের মধ্যে আধুনিক ডিভাইসগুলো যে শিশুর দৃষ্টিশক্তির ক্ষতির কারণ হতে পারে, সে সম্পর্কে নেই সচেতনতা। আবার অনেকে কিছুটা উপায়হীন হয়ে শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছেন এসব গেজেট। ফলে তাদের চোখের স্বাস্থ্যে পড়ছে দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব। বলা চলে, উল্লিখিত কারণে দৃষ্টিত্রুটি একটি উদীয়মান স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে এখন হাজির আমাদের দেশে।
শিশুর সার্বিক শিখন সক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত দৃষ্টিত্রুটির বিষয়। এটি মোটামুটিভাবে প্রতিকারযোগ্য একটি সমস্যা। দৃষ্টিত্রুটির কারণে শিশুদের সাধারণত দূরে বা কাছে দুই ধরনের দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দেয়। অল্প বয়সে শনাক্ত করা গেলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও চশমা দিয়ে দৃষ্টিত্রুটি অনেকটা নিরাময় বা সংশোধন করা সম্ভব বলে চিকিৎসকদের ভাষ্য। দৃষ্টিত্রুটির সমস্যাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেশ আগেই ভিজুয়াল হেলথ স্ক্রিনিং গাইডলাইন এবং এ-সংক্রান্ত ট্রিটমেন্ট প্রটোকল প্রণয়ন করেছে। দেশে দেশে তা অনুসরিত হচ্ছে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোয় শিশুর চোখ পরীক্ষা অনেকটা বাধ্যতামূলক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সেখানে স্কুলে ভর্তির পর পরই শিশুদের চোখ পরীক্ষা করা হয়। এমনকি লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশ পেরুতেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে স্কুল পর্যায়ে শিশুদের চোখ পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ভারতও। দেশটিতে প্রতিকারযোগ্য দৃষ্টিত্রুটি নির্মূলের অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। গত বছর সেখানে এ-সম্পর্কিত একটি বিস্তারিত ম্যানুয়াল প্রকাশ করা হয়েছে। তার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অন্য দেশের অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন আমলে নিয়ে আমাদের দেশেও এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বৈকি।
আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেকোনো সমস্যাকে শুরুতে গুরুত্ব না দেয়ার একটি প্রবণতা বিদ্যমান। সমস্যার ব্যাপকতা বাড়লেই কেবল সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে হস্তক্ষেপ করা গেলে সুনির্দিষ্ট সমস্যা সহজেই সমাধান সম্ভব। দৃষ্টিত্রুটির সমস্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে আর অবহেলার সুযোগ নেই। এটি প্রতিরোধে বিপুল অর্থের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। প্রথমত, গবেষণা বাড়িয়ে সমস্যার ব্যাপকতা কেমন, সেটি বুঝতে হবে। কোন কোন এলাকায় দৃষ্টিত্রুটির প্রকোপ বেশি, তা চিহ্নিত করতে হবে। দুঃখজনকভাবে দেশে এখন পর্যন্ত স্কুল পর্যায়ে শিশুর দৃষ্টিশক্তি স্ক্রিনিংয়ের কোনো গাইডলাইন প্রণীত হয়নি। এটি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
শিশুদের দৃষ্টিত্রুটির সমস্যা সমাধানে তিন ধাপে হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে। প্রথমত, প্রতিটি স্কুলে অন্তত একজন শিক্ষককে শিশুদের দৃষ্টিশক্তির যথার্থতা নির্ণয়ে প্রশিক্ষিত করা এবং রেফারেল ব্যবস্থা গড়ে তোলা; দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের নিরীক্ষায় দৃষ্টিত্রুটি চিহ্নিত শিশুদের আই-কেয়ার প্রতিষ্ঠানে পাঠানো; তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে উচ্চমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান। এ তিন ধাপে হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে পেরুতে যথেষ্ট সুফল মিলেছে। আমাদের ভালো চিকিৎসা অবকাঠামো বিদ্যমান। এটা এখানেও সম্ভব। সর্বোপরি, চোখের স্বাস্থ্য বিষয়ে অভিভাবক ও শিশুদের সচেতনতা বাড়িয়ে তোলাও দরকার। এজন্যও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া চাই।
স্কুলে পড়াকালীন বছরগুলো শিশুর শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আচরণগত উন্নয়নের গাঠনিক সময়। এ সময়ে দৃষ্টিশক্তিতে যেকোনো সমস্যা শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন, পরিপক্বতা ও ভবিষ্যৎ জীবনের নৈপুণ্য ব্যাপকভাবে ব্যাহত করতে পারে। কাজেই চোখের স্বাস্থ্য ঠিক রাখাটা জরুরি। একটি কর্মনৈপুণ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে চোখ পরীক্ষা স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার অঙ্গীভূত অনুষঙ্গে পরিণত করতে হবে। বিষয়টি আমলে নিয়ে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের কার্যকর পদক্ষেপ ও সদিচ্ছা কাম্য।