কম পড়া ও অনভ্যাসের চাপে শিক্ষার্থীরা
নিউজ ডেস্ক।।
করোনা মহামারির কারণে দুদফায় দেশের স্কুল-কলেজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা লাটে উঠেছিল। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসন তা স্বীকার করতে নারাজ। তাদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। পড়াশোনার নতুন পদ্ধতি অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষা ‘পোক্ত’ হয়েছে।
অপরদিকে শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলেছেন, রাজধানীসহ কয়েকটি বড় শহরের বাইরে মসৃন ইন্টারনেট যোগের অভাবে এবং বহু ক্ষেত্রে অর্থাভাবে স্মার্টফোন না থাকায় অনলাইন শিক্ষার সুবিধা পায়নি দেশের এক বিশাল অংশের শিক্ষার্থী। কম পড়ার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তবু তারা প্রমোশন পেয়েছে। কম পড়া ও অনভ্যাসের কারণে এখন শিক্ষার্থীরা চাপে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে স্কুল ছিল বন্ধ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নামমাত্র পড়াশোনা, অটো প্রমোশন, পরীক্ষায় ১০টির বদলে ২টি প্রশ্নের উত্তর লিখলেই পাস- এমন ধারণা শিক্ষার্থীদের এত দিন কম পড়ার দিকে চালিত করেছে। পাশাপাশি অনভ্যাসও তৈরি করেছে। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই গেল ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং চলতি মার্চের শুরু থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে সশরীরে পাঠদান শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার থেকে পুরোদমে পাঠদান শুরু হচ্ছে। তবে কীভাবে পুরোদমে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হবে তার কোনো রূপরেখা এখনো দিতে পারেনি প্রশাসন। পাশাপাশি শিখনফলে শূন্যতা কাটাতেও কোনো ‘দাওয়াই’ দিতে পারেনি শিক্ষা প্রশাসন।
বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধের পর পাঠদান কার্যক্রম শুরু হওয়ায় পড়াশোনায় খানিকটা গতি আসছে। পাঠদান শুরু হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদেরও লিখতে হচ্ছে, পড়তে হচ্ছে। সরজমিন ঘুরে শিক্ষার্থীদের কারো খাতার দিকে তাকিয়ে দেখা গেছে, হাতের লেখা আগের মতো সুন্দর নেই। এমনকী লেখার গতিও কমে গেছে। পড়তে বসে এদিক-ওদিক তাকানোর মানসিকতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন নামমাত্র পড়ে এসে এখন
‘পড়াশোনা’কে তাদের কাছে চাপের মনে হচ্ছে। অনভ্যাসের এই কারণে ‘চাপ’ তৈরি হলেও অভিভাবক ও শিক্ষকরা আশা করছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা ‘আনন্দপাঠে’ ফিরবে।
শিক্ষা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, শিক্ষার্থীরা যাতে চাপে না পড়ে সেজন্য স্কুল খোলার আগেই সিলেবাস কাটছাঁট করা হয়েছে। এর ফলে তাদের চলতি বছর পুরো সিলেবাস পড়তে হবে না। এতে শিক্ষার্থীদের বেশি চাপে পড়ার কথা না। কম সিলেবাস পড়ার পরে ধীরে ধীরে তারা অনভ্যাস কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু কীভাবে- এমন প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান পুরো বিষয়টিকে সরলভাবে দেখলে হবে না জানিয়ে বলেন, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকা, নামমাত্র পড়াশোনা এবং অটো প্রমোশনের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। তারা বুঝে গিয়েছিল, এখন পরীক্ষা পাস করতে গেলে আগের মতো ১০-১২টি অধ্যায় পড়া লাগে না। ২-৩টি অধ্যায় পড়ে দুটো প্রশ্নের উত্তর দিলেই পরীক্ষা পাস। এসব ধারণা থেকে তাদের মধ্যে কম পড়ার অনভ্যাস তৈরি হয়েছে। এখন স্কুল খুলে দেয়ায় পড়াশোনায় চাপ বেড়েছে। তার মতে, শিক্ষার্থীদের এখনই চাপ দেয়া যাবে না। তাদের আগে স্কুলে নিয়মিত হাজির হওয়ার উৎসাহ দিতে হবে। প্রতিদিন সব ক্লাস না করিয়ে ৪-৫টি ক্লাস করানো উচিত। এর ফলে স্কুলে নিয়মিত আসার অভ্যাস গড়ে উঠবে। ধীরে ধীরে শিখন শূন্যতাও কাটানো যাবে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা শামসুর রহমান বলেন, নবম শ্রেণি পড়ুয়া তার ছেলে এমনিতেই পড়তে চায় না। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ। এই ছেলেকে কীভাবে আবার পড়ার টেবিলে বসাব- এ নিয়ে ভেবে কূল পাচ্ছি না। রাজশাহীর একটি উপজেলা শহরে থাকেন এমন এক ছাত্রীর মা বলেন, সব বিষয় অনলাইনে পড়েছে, কিন্তু এখন এসে কিছুই মনে রাখতে পারছে না, একই সঙ্গে লিখতেও পারছে না। কী যে করি? বাধ্য হয়ে তিনজন গৃহশিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি।
একাধিক শিক্ষার্থী বলেছে, কাটছাঁট করা সিলেবাস অনুযায়ী পড়া হচ্ছে। কিন্তু মনে ভয়- কাটছাঁট করা সিলেবাস থেকেই তো প্রশ্ন আসবে? আগামী জুন থেকে কাটছাঁট করা সিলেবাসের উপরে মাধ্যমিক ও এবং আগস্ট থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হওয়ার কথা। আর এই পরীক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্ন। তাদের মতে, একটুও পড়া হয়নি। অটোপাস দিলেই তো ভালো। সিলেটের ছাত্র স্নেহাশীষ চৌধুরী বলছে, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত হলেও স্কুল বন্ধ থাকায় অনলাইনে সব কিছু স্যারের কাছ থেকে জেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। এখন স্কুল খোলায় স্যারদের এটা-ওটা জিজ্ঞেস করছি। শ্রীমঙ্গলের একজন চা শ্রমিক সন্তান শিক্ষার্থী জানায়, স্কুল চালু থাকলে একটা অভ্যাস থাকে, বাড়িতে সেটা ছিল না। আর সে চা বাগানের বাসিন্দা হওয়ায় অনলাইন সুবিধাও পায়নি। এখন কূল পাচ্ছে না।
শিক্ষকরা বলেছেন, এবার পরীক্ষার্থীসহ শিক্ষার্থীদের নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যা অন্যান্যবার হয়নি। তবে তাতে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই বলে আশ্বাস দিয়ে শিক্ষকরা বলেছেন, ভয় কাটিয়ে পড়াশোনায় ফিরতে হবে। পরীক্ষাও দিতে হবে। শিখনফলে শূন্যতা রাখা যাবে না। জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। মানুষের উন্নতি না হলে উন্নয়নও স্থায়ী হয় না।
এর আগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ-২০২১’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইনের মাধ্যমে চলা দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে ৬৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নেয়নি। দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ না নেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৭ দশমিক নয় শতাংশ শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় স্মার্টফোনের অভাবে শিক্ষাবঞ্চিত হয়েছে। অনলাইন ক্লাস আকর্ষণীয় না হওয়ায় ১৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশ নেয়নি। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসন অনলাইন শিক্ষার কথা বলে ‘তৃপ্তির ঢেঁকুর’ তুলছে। সুত্র ভোরের কাগজ