এসএসসি দিতে চান ৭৭ বছরের সাজেদা, সাহস দিলেন উপাচার্য
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ সাজেদা বেগম। একটি অনুপ্রেরণার নাম। অদম্য একজন নারী! আবহমান বাংলার একজন হার না-মানা মায়ের গল্পের মতো জীবন তাঁর। প্রায় ৭৭ বছর বয়সী বৃদ্ধা তিনি।
বুক ভরা স্বপ্ন, দৃঢ়চেতনা আর অসীম সাহসই তাঁর সঞ্জীবনী শক্তি। দৃষ্টিশক্তির অস্পষ্টতা, শারীরিক অসুস্থতা কিংবা বয়সের ভার- কোনো কিছুই রুখতে পারেনি তার পথচলাকে।
হ্যাঁ, গতকাল বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা আঞ্চলিক কেন্দ্রে এসএসসি ভর্তি পরীক্ষার হল পরিদর্শনকালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার দেখতে পান সাজেদা বেগমকে।
‘বাউবির দীক্ষা : সবার জন্য উন্মুক্ত কর্মমুখী, গণমুখী ও জীবনব্যাপী শিক্ষা’- এই স্লোগান সামনে রেখে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম/জেএসসি বা সমমানের সনদ নেই যাদের, তাদের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে এসএসসি প্রগ্রামে ভর্তির সুযোগ করে দেন।
দেশব্যাপী সাজেদা বেগমের মতো সাড়ে তিন হাজার শিক্ষাবঞ্চিত আগ্রহী শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের পথ উন্মুক্ত হয়। ফলে রাতজাগা দীর্ঘশ্বাস, বুকজুড়ে রক্ষণ আর হতাশার শেকল ছিঁড়ে নতুন আলোয় উদ্ভাসের সুযোগ পান তারা। গল্পে গল্পে শুনি সব চক্ষুলজ্জা, অবসাদ আর শৃঙ্খলার সীমানা পেরিয়ে আসা সাজেদা বেগমের শিক্ষা বিরতি, ব্যক্তিজীবন, স্বপ্ন ও আগামীর কথা।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগে জন্ম তাঁর।
আরো স্পষ্ট করে বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। বর্তমান এয়ারপোর্ট ১ নম্বর টার্মিনালেই ছিল তাদের আদি বাড়ি। নবাব হাবিবুল্লাহ গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন সাজেদা বেগম। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের ইয়ং অফিসার আবুল হাসেমের সঙ্গে। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট, বাস্তবতায় অষ্টম শ্রেণিতেই খাঁচাবন্দি হয় সাজেদা বেগমের স্বপ্ন।
এরপর কোলজুড়ে বড় মেয়ে হাসিনা আখতার, মেজো ছেলে মাসুদ রানা ও ছোট সন্তান মাসুম রেজা আসে। হাড়ভাঙা শ্রম আর স্বপ্ন লালন করে মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি করান।
বর্তমানে তিনি সোনালী ব্যাংকের এজিএম। মাসুদ রানা কম্পিউটার সায়েন্সে জার্মানি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন আর মাসুদ রেজা উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করে ব্যবসা করছেন।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির খবর পেলেন কিভাবে জানতে চাইলে সাজেদা বেগম বলেন- ‘একদিন ছোট ছেলে একটা পত্রিকা নিয়ে এসে বলল, ‘দ্যাখছো মা কিশোরগঞ্জের বাউবির এই ছেলে চা বিক্রি করে এসএসসি পাস করেছে, তোমার তো লেখাপড়ায় খুব আগ্রহ, তুমিও পরীক্ষা দাও। আমরা তোমার লগে আছি।’ ব্যস! সেদিন থেকেই বড় মেয়ের সঙ্গে বাউবিতে আসা-যাওয়া।
প্রথমে লজ্জা লাগলেও পরে দেখি- সব বয়সের নারী পুরুষ, ডাক্তার, চাকরিজীবী, সচিব, পুলিশ, আর্মি, শারীরিক প্রতিবন্ধী- সবাই এখানে বিভিন্ন প্রগ্রামে পড়াশোনা করে। আমার মনে শক্তি জাগল। ছোট ছেলে ও নাতি মোবাইলে ইন্টারনেটে দেখিয়ে দিল কিভাবে ক্লাস হয়, কী কী বিষয় পড়তে হয়। ভর্তি, টাকা জমা, নোটপত্র, বই সব মোবাইলে। সব কিছু এত সহজ হয়ে গেল যে মনে হলো যেন বুক থেকে পাহাড় সরে গেল। বাউবির শিক্ষাব্যবস্থা এত সহজ, সুন্দর! এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না। আজকে ভিসি স্যারসহ সবাই আমাকে খুব উৎসাহ, সাহস দিলেন।’
সঙ্গে আসা বড় মেয়ে হাসিনা আখতার বলেন, ‘আমার এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে মা ব্যাপক জনপ্রিয়। অসংখ্য মানুষের দৈনিক রোজগারের টাকা আম্মার কাছে তারা আমানত হিসেবে রাখেন। জিম্মাদার খালা নামে ডাকেন তারা। মা নকশিকাঁথা খুব সুন্দর সেলাই করেন। একসময় বাণিজ্যিকভাবে সেলাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমরা। মায়ের নান্দনিক সুনিপুণ কারুকাজ আমাদের বিস্মিত করে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় আদি ভাষায় অর্ধশত বিয়ের গীত জানেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনের বিয়ের অনুষ্ঠানে এখনো ডাক পড়ে আম্মার।’
জীবন সায়াহ্ণে এসে কী স্বপ্ন দেখেন আপনি, এমন প্রশ্নের জবাবে সাজেদা খাতুন বলেন, ‘আমি অনেক দূর পড়াশোনা করতে চাই। আল্লাহ বাঁচায়ে রাখলে বাউবি থেকে এসএসসি, এইচএসসি পাস করে নকশিকাঁথা নিয়ে কাজ করে এমন একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একদিন আমি ভর্তি হব।’
সুযোগবঞ্চিত, অবহেলিত, নারীদের শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কে বাউবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, সাজেদা বেগম একটি সাহসের নাম। একজন অনন্যা, অপরাজিতা। শিক্ষাবঞ্চিত নারীদের আদর্শ। এ দেশে অসংখ্য নারী আছেন মেধাবী, কিন্তু সামাজিক, পারিবারিক চাপ, কৈশোরে বিয়ের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। বাউবির শিক্ষাক্রম সব সময় তাদের পাশে। আমরা সারা দেশেই সব বয়সের, পেশার নাগরিকের ঘরে বসে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছি। এমনকি সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, দুবাই, ইতালিতে অবস্থানরত বাঙালি রেমিট্যান্সযোদ্ধারা সেখানে বসে এখন বাউবির বিভিন্ন প্রগ্রামে শিক্ষা গ্রহণ করছে।
পটুয়াখালীর সাগড়পারের জেলে হাসান শেখ, কিশোরগঞ্জের চা বিক্রেতা হারুন মিয়া, বগুড়ার হুইলচেয়ারের যোদ্ধা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নুরজাহান রিয়া কিংবা নারী সাফ ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুন, মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ফটোগ্রাফার নিজামুল বিশ্বাস- এরা সবাই বাউবির স্টুডেন্ট। সব মিলিয়ে দক্ষতা, শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ও আলোকিত মানুষ গড়তে বাউবি আজ একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান।