এমএলএম ও ই-কমার্সের নামে প্রতারণা রোধ আইন করতে চায় সরকার
নিউজ ডেস্ক।।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ও ই-কমার্সের নামে ব্যবসা খুলে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতি রোধে এবার আইন প্রণয়নের চিন্তা করছে সরকার। বেসামাল বাণিজ্য, কোটি গ্রাহকের হাহাকার, উচ্চ আদালতের নানা নির্দেশনা ও বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে সরকার এ নিয়ে শক্ত হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় এ খাতে প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা বাড়ছে। দীর্ঘ হচ্ছে ভুক্তভোগী গ্রাহকের মিছিল। তাদের চিৎকার এবার প্রশাসনের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে যে প্রতারণা হচ্ছে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে এখনো পর্যন্ত কোনো আইন নেই। শুধু নীতিমালা ও নির্দেশিকার আলোকে ই-কর্মাস ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তবে ব্যবসার নামে এক শ্রেণির প্রতারক অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করছেন। ফলে অগ্রসরমাণ এ খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতাও তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ১১টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি গ্রাহকদের কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর আগে আইনের অভাবে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এরপর সরকার ২০১৩ সালে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম নিয়মনীতির মধ্যে আনতে ‘মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩’ প্রণয়ন করে। এমএলএম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন থাকলেও কোন
প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ দেশে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা লাইসেন্স ছাড়াই এই ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। তাদেরই কেউ কেউ আবার প্রতারণার ধরন পাল্টে ই-কমার্স, ই-বিজনেস ও ডিরেক্ট টেলিমার্কেটিং, ক্যাশলেস সোসাইটি প্রভৃতি নামে বিভিন্ন ‘এমএলএম কোম্পানি’ গড়ে তুলেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন এনে তারা এ ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটি সরকারকে নতুন করে ভাবাচ্ছে। এরইমধ্যে প্রতারণার মাধ্যমে ইভ্যালি গ্রাহকের প্রায় হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে এ ধরনের প্রতারণা বন্ধে সরকার যুগোপযোগী নতুন আইন প্রণয়ন করার কথা ভাবছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও হয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। এখন আনুষ্ঠানিক আলোচনায় উঠে আসবে আইন প্রণয়নসহ নানা দিক।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষা, চলমান পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের করণীয় ঠিক করতে আজ বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপির সভাপতিত্বে পর্যালোচনা সভা হবে। সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক উপস্থিত থাকবেন। গ্রাহকের ক্ষোভ প্রশমন, নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের করণীয়, নীতিমালা পর্যালোচনা ও আইন প্রণয়নের বিষয়ে আজকের বৈঠকে আলোচনা হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি আমাদের সময়কে বলেছেন, ই-কমার্স জালিয়াতি বন্ধে ইতিমধ্যে আন্তঃ মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে। ই-কমার্স খাতকে সুশৃঙ্খল রাখতে যা যা করণীয় তা করা হবে। প্রয়োজনে ই-কমার্স আইন প্রণয়ন করা হবে।
ই-কমার্স নীতিমালার ৩.৫ এর(৩) ধারায় বলা আছে, ‘ডিজিটাল কমার্স সংশ্লিষ্ট অপরাধ চিহ্নিত হলে তা দেশে প্রচলিত সংশ্লিষ্ট আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ নীতিমালার ৩.৬ এর(১) ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল কমার্স ব্যবসা পরিচালনা, বিক্রয়কৃত পণ্য সরবরাহ ও আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ তদারকি এবং এর সব কর্মকা- হতে উদ্ভূত অসন্তোষ নিরসন ও অপরাধগুলোর বিচার ডিজিটাল নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট আইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। এই নীতিমালার আলোকে করোনাকালীন দেশে ই-কমার্স বাজার সম্প্রসারণ হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় বর্তমানে সারাদেশে ১ হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পরিচালনা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন রয়েছে।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য বলছে, ১ হাজার ৬০৯টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আছে দেশে। বহুল আলোচিত ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। এ টাকা ফেরত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ই-অরেঞ্জের গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা নিয়েছে। গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ধামাকার ৮০৩ কোটি টাকা, এসপিসি ওয়ার্ল্ডের ১৫০ কোটি টাকা। এছাড়া নিরাপদডটকম ৮ কোটি, চলন্তিকা ৩১ কোটি, সুপম প্রোডাক্ট ৫০ কোটি, রূপসা মাল্টিপারপাস ২০ কোটি, নিউ নাভানা ৩০ কোটি এবং কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং গ্রাহকদের ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানসহ সিআইডি মোট ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিরীক্ষা করছে ৯টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে। বেশির ভাগের বিরুদ্ধে গ্রাহককে পণ্য না দেওয়া, টাকা ফেরত না দেওয়া, চেক দিলেও ব্যাংকে টাকা না থাকা এবং সরবরাহকারীদের টাকা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
শনিবার এক অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, দেশে ই-কমার্সের ব্যাপক প্রসার হলেও আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি ও পরিবীক্ষণ না থাকায় এই খাতে জবাবদিহিতা গড়ে ওঠেনি। কিছুসংখ্যক মুনাফালোভী প্রতারক গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুণœ করে টাকা লুট করছে। যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ লুট করেছে তাদের সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে প্রতারিত হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা নিতে হবে। ই-কমার্স ব্যবসায় প্রতারণা ঠেকাতে আইন প্রণয়ন জরুরি।