এবার ভারতের মহিষ দুধের ঘাটতি মেটাবে
নিউজ ডেস্ক।।
সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, মাছ ও গোশত উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে বর্তমানে দেশে প্রায় ৪৫ হাজার টন দুধের ঘাটতি রয়েছে। দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ভারত থেকে ‘মুররাহ’ নামে উন্নতজাতের মহিষ আমদানি এবং সেগুলো থেকে ক্রস ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে অধিক দুধ উৎপাদনকারী মহিষের বংশবিস্তার করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরপর এই উন্নতজাত সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে।
এতে যেমন দুধের ঘাটতি মিটবে, তেমনি গোশত উৎপাদনও বাড়বে কয়েক গুণ। এ লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) তত্ত্বাবধানে মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) এবং মহিষ গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্প কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দুধ ও গোশত উৎপাদনের পাশাপাশি ভারবহনেও মহিষ অতুলনীয়। দেশে এক সময় দেশীজাতের মহিষের গাড়ির বেশ প্রচলন ছিল। যদিও এখন সেটা কম দেখা যায়। উন্নত প্রযুক্তির প্রজনন ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মহিষের দুধ উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশেও মহিষ পালন বেশ লাভজনক ও সম্ভাবনাময়। এ জন্য উন্নত প্রযুক্তি, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজনন কৌশল ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োগের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন করতে হবে।
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় উন্নত জাতের মহিষ পালন কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে সরকার ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রায় ১৬৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ২০২৩ সালের জুন নাগাদ এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। এই প্রকল্পের পরিচালক ডা: মো: মুহসীন তরফদার রাজু গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রকল্পের সামগ্রিক কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রায় ৪৫ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জানা যায়, মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের (২য় পর্যায়) মাধ্যমে সরকারি মহিষ খামারসহ (সাভার, ঢাকা, সন্তোষ, টাঙ্গাইল এবং বাগেরহাট) দেশের মোট ২০০টি উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গোশত ও দুধের চাহিদা পূরণে ভারত থেকে মুররাহ প্রজাতির ১৬০টি মহিষ আনা হচ্ছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, চলতি মাসেই একটি কারিগরি কমিটি প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শনে (পিএসআই) ভারত যাবেন। তিনি আরো বলেন, মুররাহ জাতের এ মহিষ বছরে ৩০০ দিন পর্যন্ত দুধ দিতে অভ্যস্ত। গড়ে এরা প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কেজি দুধ দেয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল মেয়াদে ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মহিষ উন্নয়ন নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ওই প্রকল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দ্বিতীয় পর্যায়ে নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় প্রাণিসম্পদ অধিদফতর।
তাদের তথ্যানুযায়ী, দেশে উৎপাদিত দুধের ৯০ শতাংশ আসে গরু থেকে, আট শতাংশ আসে ছাগল থেকে এবং দুই শতাংশ আসে মহিষ থেকে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ২৩.৭০ লাখ টন, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে উন্নীত হয়েছে ১০৬.৮০ লাখ টনে। বর্তমানে দেশে মোট দুগ্ধ উৎপাদনকারী গরু ৮.৬ মিলিয়ন, যার মধ্যে দেশীয় ৪.৫৬ মিলিয়ন (৫৩ শতাংশ) এবং সংকর জাতের ৪.০৪ মিলিয়ন (৪৭ শতাংশ)। বর্তমানে মাথাপিছু দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ১৭৫ মিলিলিটার। দেশে বছরে ১৫২ লাখ টন দুধের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ১০৬.৮ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫২.০২ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দুধ উৎপাদন হয় ১০৬.৮০ লাখ টন। এ চাহিদা অনুযায়ী সরকার আরো ৪০.২২ লাখ টন দুধ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহিষের গোশত ও দুধে কোলেস্টেরলের মাত্রা অন্য প্রাণীর চেয়ে কম, যা স্বাস্থ্যসম্মত। মহিষের দুধে আমিষের পরিমাণ ৪.৫ শতাংশ ও চর্বির পরিমাণ ৭.৫ শতাংশ। মহিষের দুধে অন্য প্রাণীর দুধের চেয়ে ৪৩ শতাংশ কোলেস্টেরল কম থাকে। ভিটামিনের পরিমাণও মহিষের দুধে বেশি। বাণিজ্যিকভাবে মহিষের দুধ ব্যবহার করে দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি অনেক লাভজনক। মহিষের দুধে সলিড বেশি থাকায় দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি (দই, ছানা, পনির ইত্যাদি) তৈরিতে গরুর চেয়ে কম দুধ লাগে।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা: মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকার দেশে গোশত ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দুধ ও গোশতের জোগান নিশ্চিত করার জন্য ভারত থেকে ভালো জাতের (মুররাহ) মহিষ সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, করোনা না থাকলে এটি আগেই আনা হতো। এখন শিগগিরই দেশে আনা হবে, সেই প্রক্রিয়া চলছে।
এ দিকে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের চলমান মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি দুধের চাহিদা পূরণে মহিষের জাত উন্নয়নে মহিষ গবেষণা ও উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের কাজও এগিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)। প্রকল্প পরিচালক ও বিএলআরআই বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. গৌতম কুমার দেব বলেন, বিগত সময়ে দেশে গরুর জাত, গোশত এবং দুধ উৎপাদনে বেশি নজর দেয়া হয়েছে। এখন দুধের চাহিদা পূরণে মহিষ লালন পালন, জাত উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হবে ৬৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এটি শেষ হবে। বর্তমানে আমরা এই প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। মহিষ পালন ও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য মহিষের দুধের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। এ ছাড়াও জাতের উন্নয়নও লক্ষ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় মহিষ সাধারণত দৈনিক দেড় থেকে আড়াই লিটার দুধ দিয়ে থাকে। আর আমাদের দেশের উৎপাদিত দুধের মাত্র ২-৫ শতাংশ জোগান দেয় মহিষ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই হার ৬৫ শতাংশ। একটি ভালো জাতের মহিষ বাচ্চা প্রসব পরবর্তী ৩০৫-৩১০ দিন পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। আর এ সময়ে প্রায় দুই হাজার লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া সম্ভব।
বিএলআরআই সূত্র জানায়, ভোলা, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, গোপালগঞ্জ, ঝালকাঠি, লক্ষ্মীপুর, নড়াইল, নোয়াখালী, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, পটুয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও জামালপুরে মহিষ পালন করা হলেও ধীরে ধীরে এ সংখ্যা কমছে।
তারা বলছেন, দেশে প্রায় ১৪ লাখ মহিষ রয়েছে। একটি দেশীয় জাতের মহিষ দৈনিক দেড় থেকে আড়াই লিটার দুধ দিয়ে থাকে। কিন্তু কিছু জাত আছে যেগুলো দৈনিক ১২ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। বাইরে থেকে এ জাতের ষাঁড় এনে ক্রস ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে বেশি দুধ উৎপাদনকারী মহিষের বংশবিস্তার করা হবে। পাশাপাশি এখন যে মহিষ রয়েছে, সেগুলোর স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটানো হবে। এর ফলে গোশত ও দুধ উৎপাদনে সফলতা আসবে।