এনটিআরসিএ’র গণবিজ্ঞপ্তির দীর্ঘসূত্রতায় বয়স পার
কোভিড মহামারির কারণে ২০২০ সাল তরুণদের জীবনে মহাসংকট বয়ে নিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সেশনজট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ থাকায় বেকারত্ব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
কভিড মহামারি তরুণ থেকে শুরু করে সবার স্বাভাবিক জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কয়েক মাস ধরে বন্ধ থাকায় লাখ লাখ বেকার তরুণ চাকরিতে আবেদনের তথা যোগদানের বয়স হারিয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে চাকরিতে যোগদানের বয়স বাড়ার দীর্ঘদিনের দাবি কোভিডকালে আরও জোরালো হয়েছে।
কোভিডকালের পরিবর্তিত বাস্তবতা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সেশনজটের শঙ্কা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা আটকে থাকার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা শুরু হয়েছে মাত্র।
যদিও এরই মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব পরীক্ষা বাকি আছে, সেসব পরীক্ষা শেষ করতেও চলতি বছর পার হয়ে যাবে! সময় চলে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে। কভিডকালে কত-শত বেকার চাকরিপ্রত্যাশীর জীবন থেকে চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হয়ে গেছে তার হিসাব কে রাখে! একজন চাকরিপ্রত্যাশী বেকারের জীবনে চাকরির আবেদনের বয়স পার হওয়ার শেষ দিনগুলো যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা সেই ভুক্তভোগীই শুধু বলতে পারবে।
কোভিড মহামারির কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। তবে চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। কোভিডের এই ভয়াবহ দুর্যোগের পরিসমাপ্তি কবে ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল! বর্তমান প্রেক্ষাপটে লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স শেষ হওয়া এবং সম্ভাব্য সেশনজটের কথা চিন্তা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো সময়ের দাবি।
শুধু কভিডকালের এ সময়ে নয়, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবিটি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সংসদের ভেতরে ও বাইরেও ব্যাপকভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। চাকরির বয়স নিয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর জোর আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো সময় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল।
চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯১ সালে। তখন চাকরিতে যোগদানের বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়েছিল। যদিও তখন গড় আয়ু ছিল ৪৫ বছর। অতঃপর প্রায় ৩০ বছর পার হতে চলল। গড় আয়ুও এখন বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও গড় আয়ু প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এমনকি অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বাড়ানো হয়নি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বছরের পর বছর শুধু বেড়েই চলেছে। প্রত্যেক বছর আগের বছরের চেয়ে আরও বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ১৬০টিরও অধিক দেশে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এর অধিক।
বাস্তবতা এটাই যে, এদেশে বর্তমানে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে, কিন্তু চাকরি নেই! বয়স ৩০ পার হওয়া মানে যেন অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখের বেশি কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এ বেঁধে রাখার ফলে সব শিক্ষার্থীর মেধা কি আদৌ কাজে লাগানো যাচ্ছে? চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হলে যে যার দক্ষতা অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার ওপর নয়, উন্নত দেশগুলো দক্ষতার ওপর সবচেয়ে জোর দিয়ে থাকে।
কোভিডে স্থবির হয়ে যাওয়া জীবনব্যবস্থায় সরকার অনেক সেক্টরে প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সম্ভাব্য সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া, কোভিডকালে লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স বিবেচনা ও দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষাপটে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা দরকার।
বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে কোনো ধরনের ক্ষতির শঙ্কা নেই, বরং সব পর্যায়ের তারুণ্যের মেধা কাজে লাগালে দেশ এগিয়ে যাবে, বেকারত্ব কমবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সুবিধাগুলো হলো
এক. চাকরিতে যোগদানের বয়স বাড়লে সেশনজটের শিকার হওয়া তথা পড়ালেখা শেষ করা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা চাকরির পড়াশোনায় প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় পাবে;
দুই. উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে;
তিন. শিক্ষিত বেকারের হার কমবে;
চার. রাষ্ট্র সব শিক্ষিত তরুণের মেধা কাজে লাগাতে পারবে;
পাঁচ. মেধা পাচার বন্ধ হবে;
ছয়. অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে;
সাত. রাষ্ট্র দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশি সময় পাবে;
আট. তরুণরা নিজেকে গুছিয়ে নিতে যেমন সময় পাবে, তেমনি বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে;
নয়. গড় আয়ু অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে;
দশ. বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনায় অবসরের বয়সসীমাও বাড়ানো যাবে;
এগারো. শিক্ষিত তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা গেলে বিদেশ থেকে কর্মী আনা বন্ধ হবে এবং বারো. সর্বোপরি তরুণ জনগোষ্ঠী ও উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন সুদৃঢ় হবে।
শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ লাখ লাখ সনদধারী এনটিআরসিএ’র (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) গণবিজ্ঞপ্তির আশায় দিন পার করছেন। শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নিমিত্তে সারা দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শূন্যপদের তথ্য অনেক আগেই সংগ্রহ করেছে ‘এনটিআরসিএ’।
সূত্রমতে, প্রায় ৬০ হাজার শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কথা ছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে।
অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেনি এনটিআরসিএ। নিবন্ধিত শিক্ষকদের পক্ষ থেকে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি দ্রুত প্রকাশের দাবিতে মানববন্ধনসহ এনটিআরসিএ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর কয়েক দফায় স্মারকলিপি প্রদান করেও আশানুরূপ ফল আসেনি।
পরিকল্পনামাফিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রশাসনিক ধীরগতি ও মামলাজটে পড়েছে এনটিআরসিএ। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না হওয়ায় গত তিন বছরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ আটকে আছে। এরই মধ্যে বয়স ৩৫ পার হওয়ায় নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হাজার হাজার নিবন্ধনধারী আবেদনের যোগ্যতা হারিয়েছেন।
প্রতিটি দিন যাচ্ছে আর এভাবে বহু মেধাবী বেকার নিবন্ধনধারীর কপাল পুড়ছে। নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতায় অনিশ্চয়তা ও হতাশায় দিন কাটছে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ লাখ লাখ নিবন্ধনধারীর। সময়মতো শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকসংকট চরম আকার ধারণ করেছে। ফলে শিক্ষার মান নিচে নেমে যাচ্ছে।
মুজিববর্ষে বেকারত্ব দূর করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ফলে গণবিজ্ঞপ্তি নিয়ে বারবার কালক্ষেপণ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অতিসত্বর গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হোক।
কোভিডকালে থমকে যাওয়া চাকরির বাজারে সারা দেশের নিবন্ধনধারী মেধাবী বেকারদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের এখনই সময়। কোভিডকালে স্থবির হয়ে পড়া তরুণদের জীবনে ২০২১ সাল ইতিবাচক বার্তা বয়ে নিয়ে আসুক, এটাই প্রত্যাশা।
সাধন সরকার, মুক্ত লেখক ও পরিবেশকর্মী