একস্ট্রিমলি সিভিয়ার সাইক্লোন উপকূলে
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ঘনীভূত হয়ে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বা একস্ট্রিমলি সিভিয়ার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছে। এর গতিপথ ভারতের ওড়িশামুখী হলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব তীব্রভাবেই অনুভূত হচ্ছে। এরই মধ্যে ঝড়ের প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জেলাগুলোয় ঝড়োবাতাস বইছে। উত্তাল হয়ে উঠেছে সমুদ্র। উপকূলে জোয়ারের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছে উপকূলবাসী।
ঢাকাসহ অনেক জেলায় থেমে-থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও কোথাও দমকা হাওয়াও বইছে। ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে বয়ে চলা মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহও প্রশমিত হয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝড়োহাওয়াসহ অতিভারী বর্ষণ হতে পারে। সেই সঙ্গে পূর্ণিমায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হতে পারে নিম্নাঞ্চলগুলো। এরই মধ্যে উপকূলীয় জেলাগুলোর নদ-নদীর পানি ফুলে ওঠার খবর আসছে।
আজ বুধবার উপকূলে আঘাত হানার সময় উপকূলীয় ১৪ জেলায় এবং চর ও দ্বীপে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিতে ঝড়োহাওয়া বয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এলাকাগুলোয় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে দেওয়া পূর্বাভাসে দেশের তিনটি সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজার উপকূলকে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এই ঘোষণার পর সারাদেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
ভারতের আবহাওয়াবিদরা ধারণা দিয়েছেন, বুধবার দুপুর নাগাদ এ ঘূর্ণিঝড় পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ এবং ওড়িশার পারাদ্বীপের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূল পেরিয়ে স্থলভাগে উঠে আসতে পারে। তখন বাতাসের গতি ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বাতাসের গতিবেগ ৮০ থেকে ১২০ কিলোমিটার হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, ইয়াস অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে ভারতে আঘাত করতে পারে। তবে বাংলাদেশের খুলনাসহ উপকূলীয় এলাকা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোয়ার এবং ঝড়োবাতাসের মুখে পড়বে। জলোচ্ছ্বাস বাড়বে বলেও জানান তিনি। আবহাওয়া অফিস বলছে, মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে; পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৯০০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড়কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়োহাওয়ার আকারে ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।
আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম জেলা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোয় ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণের সঙ্গে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে দমকা বা ঝড়োহাওয়া বয়ে যেতে পারে। পূর্ণিমার প্রভাবে উপকূলের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুটের বেশি উচ্চতার জোয়ার প্লাবিত হতে পারে।
আমাদের সময়ের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুসারে, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের জেলাগুলোয় ঝড়োবাতাস বয়ে যাচ্ছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনার নিচু এলাকা এবং চরাঞ্চলে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ টপকে ও ভেঙে ওই পানি প্রবেশ করছে। সুন্দরবনের দুবলারচরসহ জেলেপল্লীগুলোর বেশিরভাগ এলাকা এরই মধ্যে ডুবে গেছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনার কয়রাসহ কয়েকটি উপজেলায় আগে থেকেই বেড়িবাঁধ ভাঙা ছিল। সে স্থান দিয়ে বসতি এলাকা এবং মাছের ঘেরে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে জোয়ারের পানির উচ্চতা। এসব এলাকার অধিবাসী নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো উপকূলবাসীকে নিরাপদ ও উঁচু স্থানে যাওয়ার জন্য মাইকিং করছে।
এদিকে ইয়াস মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার বিভাগে কন্ট্রোলরুম খোলার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি, মাঠ পর্যায়ের সব সরকারি কর্মকর্তাদের সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি গতকাল অনলাইনে আয়োজিত প্রস্তুতিমূলক এক জরুরি সভায় সভাপতির বক্তব্যে এ নির্দেশ দেন।
উপকূলীয় এলাকার শতভাগ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় জানায়, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবিলায় সরকারের সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে। করোনা সংক্রমণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তিনগুণ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় রাখতে শতভাগ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, কোভিডের কারণে তিনগুণ আশ্রয়কেন্দ্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবহার, সবার জন্য মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিশ্চিত করা হয়েছে। ফণী, বুলবুল, আম্পান মোকাবিলায় অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করা হবে।
গতকাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝড়োহাওয়াসহ বৃষ্টি ও বজ্রবৃষ্টি হয়েছে। এ সময় সন্দ্বীপে দেশের সর্বোচ্চ ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৩৬ মিলিমিটার।
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে নদী ও খালের পানি বেড়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে হাজার হাজার পরিবার। সকালে নদ-নদীর পানির উচ্চতা দুই থেকে আড়াইফুট বাড়ায় বাগেরহাটের শরণখোলার ভোলা, বলেশ্বর, মোরেলগঞ্জের পানগুছি, ভৈরব নদীর পাশে বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা এলাকাগুলো প্লাবিত হয়।
ভোলা প্রতিনিধি জানান, ঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা ভোলায় দিনভর ঝড়োবাতাস বয়ে গেছে। ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ ১৪ কিলোমিটার। নদী ছিল উত্তাল। অন্যদিকে ঝড়ের প্রভাবে মেঘনার পানি বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে চরফ্যাশনের কুকরি-মুকরি, ঢালচর ও চরপাতিলাসহ বেশ কিছু নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঝড়ের কবলে পড়ে একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে গেছে। তবে এতে কেউ মারা যায়নি।
পটুয়াখালীর নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে স্বাভাবিক জোয়ারের থেকে পানি ২-৩ ফুট বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার অন্তত পাঁচটি পয়েন্টে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশ করে ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে রয়েছেন ২০ হাজার মানুষ।
মির্জাগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের পায়রা ও শ্রীমন্ত নদীপাড়ের বিড়িবাঁধ ভেঙে ৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
গলাচিপা প্রতিনিধি জানান, স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে উপজেলার কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি মানুষগুলো চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।
বাউফল প্রতিনিধি জানান, বাউফলের উপকূলবর্তী প্রমত্তা তেঁতুলিয়া ও লোহালিয়া নদীর পানি গত দুই দিন ধরে ক্রমেই বাড়ছে। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসের গতিবেগ ছিল অস্বাভাবিক। সোমবার দুপুর থেকেই জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে উপকুলীয় উপজেলার বিচ্ছিন্ন কয়েকটি নিম্নাঞ্চল।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, ঝড়োহাওয়ার সঙ্গে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। সুন্দরবনসংলগ্ন নদীগুলোতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনার আগাম ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে হাতিয়ার নিম্নাঞ্চলের অনেক লোকালয়। এ ছাড়া নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের চারটি গ্রাম সম্পূর্ণভাবে পানিতে তলিয়ে গেছে।
পাথরঘাটা (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, বিষখালি ও বলেশ্বর নদীর পানি বিপদসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, বরগুনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক মো. মাহতাব হোসেন। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাথরঘাটা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ।
খুলনা প্রতিনিধি জানান, গতকাল মঙ্গলবার সকালে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে কয়েক ফুট। এতেই বাঁধের কানায় কানায় উঠেছে পানি। কোথাও কোথাও বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে।