একজন হুসাইন আলমের জীবনের গল্প
এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
আমাবস্যার রাতে গ্রামের কোন এক কুড়ে ঘরে ১৯৯১ সালে হঠাৎ করে পূর্ণিমার ঝলমলে চাঁদ উঠেছিল। কিন্তু কে জানতো এই ছেলেটাই একদিন গুটি গুটি পা বারিয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম ছড়াবে।হ্যাঁ এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনি বাংলাদেশী ছেলে পোল্যান্ডে বসবাসরত মোঃ হুসাইন আলম। যার একাডেমিক অর্জন রীতিমতো ইউরোপসহ সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছে।
কথা হচ্ছিলো হুসাইন আলমের সাথে। হুসাইন আলম বলেন-
কষ্ট দিয়ে অর্জন করেছি সাফল্যের এই স্বপ্ন গুলোকে। আমার চোখের পানি কলমের কালি হয়ে ঝরেছে প্রতিটা পরীক্ষাতে।যেখানে লেখা পড়া করাটাই আমার জন্য ছিলো বড় কষ্টের। সেখানে লন্ডনসহ ইউরোপের রাঙ্কিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট অর্জন করেছি বড়ই কষ্ট করে।আমার জন্ম গ্রামে ৷ যে গ্রামে আমার সময় পাকা রাস্তা ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না এমন কি শিক্ষার আলো অনেক মানুষের ভাগ্যেই জোটে নাই বা এখনো শিক্ষার হার অনেক কম।
মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার ঘুল্লিয়া গ্রামে আমার জন্ম। ছোটবেলায় আমার বেড়ে ওঠা এই গ্রামেই। এক কথায় আমি গ্রামের ছেলে।যেহেতু আমার গ্রামে কোন হাই স্কুল ছিল না তাই অনেকটা অনিচ্ছার সত্ত্বেও বাবা মার ইচ্ছা পূরণ করতে ভর্তি হতে হয়েছিল ঘুল্লিয়া দাখিল মাদ্রাসা তে। এই ঘুল্লিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকেই আমি দাখিল পাস করি ২০০৫ সালে।
গ্রামের পরিবেশে যা হয়। সন্ধ্যাবেলায় আশপাশের লোকেদের চিৎকার-চেঁচামেচি ও গান বাজনার কারণে আমি ও আমার ছোট বোন লেখাপড়া করতে পারতাম না।যার ফলে কষ্ট হলেও আমাদের কে সন্ধ্যার সময় ঘুমিয়ে যেতে হতো।আমার মা জেগে থাকত এবং রাত বারোটার পরে আমাদেরকে ঘুম থেকে তুলে দিতো পড়ালেখার জন্য আমি আর আমার ছোট বোন নাজমা সারারাত জেগে লেখাপড়া করতাম। আমি আর আমার ছোট বোন একই ক্লাসে পড়তাম। অভাবের কারণে দুই সেট বই না কিনে এক সেট বই কিনে দুজন একসাথে পড়তাম। মাঝে মাঝে হাতে লিখে নিয়ে নোট করে পড়তাম।
আমার বড় ইচ্ছা ছিল সাইন্স নিয়ে পড়ার।আমাদের মাদ্রাসায় সাইন্স না থাকায় এবং মাদ্রাসা থেকে টিসি না দেওয়ার কারণে আমাকে মানবিক বিভাগে লেখাপড়া করতে হয় যার ফলে আজ মানুষের ডাক্তার না হযে হতে চলেছে সাইন্টিফিক রিসার্চার পিএইচডি.
সেই ক্লাস ফাইভ থেকে টিউশনি করা শুরু করেছিলাম আর লন্ডন যাওয়ার আগ পর্যন্ত করিয়েছিলাম। আমি বাংলাদেশ হতে দাখিল এবং আলিম পাশ করেছিলাম এবং অনার্স করেছি ইউনিভার্সিটি অফ সান্ডারল্যান্ড লন্ডন থেকে মাস্টার্স শেষ করেছি Canterbury Christ Church University, UK থেকে Ph.D করছি ইউনিভার্সিটি অফ Wroclaw, Poland থেকে।
লন্ডনে আমার এক বছরে খরচ ছিল ২০ থেকে ২২ হাজার পাউন্ড। এতো গুলো টাকা ইনকাম করে লেখাপড়া করতে কিচেন পটার, ক্লিনিং সহ আমাকে তিনটা জব করা লাগতো। সকালে ক্লিনিং জব তারপর ইউনিভার্সিটি অফ ক্যান্টের হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এর জব এবং বিকালে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের জব করতাম রাত্র বারোটা পর্যন্ত। জব শেষে সারারাত জেগে লেখাপড়া করতাম। কত যে চোখের পানি ঝরেছে এবং ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরীতে কত রাত যে আমি ঘুমিয়েছি তা আমার মনে নাই।
আমার মনে আছে শুক্র, শনি ,রবিবার এই তিন দিন ঘুম কি জিনিস আমার তা জানা ছিল না। একটাই লক্ষ্য ছিল যতই কষ্ট হোক না কেন টাকা রোজগার করে আমাকে লেখাপড়া শেষ করতেই হবে। তাই হাজার কষ্টকে আমি আশার বাণী হিসেবেই নিয়েছিলাম।
আমি দ্বিতীয় বাংলাদেশি যে Canterbury Christ Church University, Canterbury, Kent, UK হতে মাস্টার্স শেষ করেছি। আমি মাস্টার্সের স্টুডেন্ট থাকাকালীন সময়ে ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ইউনিয়নের পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট অফিসার ছিলাম (ইলেক্টেড)
আমি এখন ইউনিভার্সিটি অফ Wroclaw, Poland এ পিএইচডি এবং টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আছি। আমি একমাত্র বিদেশী Ph.D ছাত্র যে সাড়ে চোদ্দশ Ph.D এর ভিতরে দুইবার বেস্ট স্টুডেন্ট Rector স্কলারশিপ পেয়েছি। সাড়ে ৪০০ বছরের পুরাতন এবং ৯ জন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ইউনিভার্সিটিতে প্রথম যেদিন ক্লাস নিতে গিয়েছিলাম। সেদিন চোখে জল এসেছিল এই ভেবে যে গ্রামের ছেলে আজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার।
আমি মাকে ফোন দিয়ে আনন্দে কেঁদে ছিলাম যেদিন সাড়ে ৪০০ বছরের ইউনিভার্সিটির রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড গড়েছিলাম মাত্র ৪ মাস ১৫দিনে পিএইচডি প্রসিজার ওপেন করে।
আমি লেকচারার হিসেবে জব করি। The International University of Logistics and Transport in Wrocław, Poland।পোল্যান্ডের ইতিহাসে আমি একমাত্র বিদেশী যে পলিশ এসোসিয়েশনের সাইন্টিফিক মেম্বার। আমার ছয়টা আর্টিকেল বের হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল হাইক্লাস জারনালে। ২৫ টারও বেশি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে আমি পেপার সাবমিট করেছি। হুসাইন আলম নমিনেশন পেয়েছিল ECPR Rising Star Award এর জন্য from dean, faculty of social science, university of Wrocław, Poland।
সাম্প্রতিক হুসাইন আলমের বুক চ্যাপ্টার Accepted হয়েছে "Disruptive Innovation and Emerging Technologies for Business Excellence in the Service Sector." এই বইতে, Role of technology for formal education in Bangladesh," এই শিরোনামে। IGI Global publisher, USA।
হুসাইন আলম বলেন, আমি বিশ্বাস করি কোন স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে কঠিন পরিশ্রম ও সদ ইচ্ছার বিকল্প নাই।