ইভিএম সম্পর্কে ৭০ ভাগ ভোটারের ধারণা নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন
# শঙ্কা, আস্থাহীনতায় ভোটার ও প্রার্থীরা
# ইভিএম ক্যাম্পেইন করছে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা
# ২৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে মক ভোটিং
‘এ্যালাও তো শুনি নাই বোলে মেশিন দিয়া ভোট দ্যাওয়া নাইগবে। আগোত তো হামরা ইয়াও দিসনো সিল, হয়া গেছিল। এখন যে কোনটা হাতে কোনটা হয় কি বুলি। কেমন করি জানি এখন।’ গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর মহানগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেকুড়া এলাকার সাবেরা বেওয়া বলছিলেন কথাগুলো। সেখানেই কথা হয় ধান শুকাতে থাকা সেকেন্দার আলীর সাথে। তিনিও জানান, ‘একনও তো হামাক কেউ বোলে নাই মেশিন দিয়া ভোট দ্যাওয়া নাইগবে। কেউ তো আসিয়া হামাক দেকায়ও নাই, ক্যামন করি মেশিন দিয়া ভোট দ্যাওয়া নাইগবে না নাইগবে। এ্যালা যদি হামাক শিকায়, তাইলে হামরা ওই সিস্টেমোত ভোট দিমো, না শিকাইলে হামরা ভোট দিবারে যাবান নই।’
শুধু সাবেরা বেওয়া কিংবা সেকেন্দার আলী নয়, রংপুর মহানগরীর ৭০ ভাগ এলাকার মানুষই এখনো শোনেননি এবার ভোট হবে ইভিএমে। যারাও শুনেছেন তাদের আবার ইভিএম সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তফশিল অনুযায়ী আগামী ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রতিটি কেন্দ্রে ইভিএম ভোট করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সে কারণে ইভিএম নিয়ে ভোটারেদের পাশাপাশি আস্থাহীনতা-শঙ্কা আছে প্রার্থীদেরও। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন বলছে ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের আনুষ্ঠানিকভাবে সচেতন করতে ২৩ ডিসেম্বর থেকে বিশেষ কার্যক্রম শুরু হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ৫৪ কিলোমিটার পৌরসভাকে বর্ধিত করে ২০১২ সালে ২০৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সিটি করপোরেশন হয় রংপুর। তবে এখনো ৭০ ভাগ এলাকাই আছে প্রান্তিক জনপদ-কৃষিনির্ভর। এসবের কিছু কিছু স্থানে রাস্তাঘাট, রোড লাইট, ড্রেন হলেও সেভাবে গড়ে ওঠেনি কোনো অবকাঠামো। ফলে কৃষিনির্ভরতাই এখনো ৮০ ভাগ মানুষের জীবিকার হাতিয়ার। তরুণ প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে উঠলেও পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রায় মানুষ শুধুই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। তারা কেবল ব্যালটের ভোটেই অভ্যস্ত। হঠাৎ করে এবারের সিটি নির্বাচনে ২২৯টি ভোট কেন্দ্রেই ইভিএমে ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত তাই তাদের কাছে অদ্ভূত ঠেকছে। বিষয়টি নিয়ে দোটানায় ভোটাররা। অনেক ভোটারই এখনো শোনেননি, এবার ইভিএম দিয়ে ভোট দিতে হবে। যারাও শুনেছেন, তারাও জানেন না ইভিএমে কিভাবে ভোট দিতে হয়।
ভোটারদের মতামত : অবস্থা জানতে সরেজমিন গেলে দেখা যায়, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ৭০ বছর বয়সী হাজেরা বেগম জানান, ‘এবার বোলে মেশিন দিয়া ভোট দ্যাওয়া নাইগবে। কিন্তু কিভাবে দেওয়া নাইগবে, তাক কবার পাই না।’
৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের রঘু বাজার এলাকার কবিরুল ইসলাম জানালেন, ‘হামরা তো শুনতেছি হামরা ভোট দেমো এক জনকাক। ওমরা ইচ্ছা কইরলে আরেক জোনকার কাছে ভোট নিয়া যাবার পাইবে। এই পদ্ধতিও আছে নাকি মেশিনোত। হামরা তো জীবনে এইগলা জানি না। হামার তো বয়স হইছে, বয়স হামার ৬৯। কোথায় টিপলে কী হবে, এটা তো শিখার বিষয় আছে। আমাদের সেন্টার রঘু হাইস্কুলে এখনও কোন শিক্ষকও জানে না, হামরাও জানি না, কি কইরমো তাহইলে কন।’
৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার মইন চৌধুরী (২৫) জানান, ‘ইভিএম মেশিনে যে ভোট হবে এটা শুনছি। কিন্তু কিভাবে ভোট দিতে হবে সেটা জানি না। আমাদের কাছে কেউ আসেও নাই। কেউ দেখায়ও নাই। না শিখলে কিভাবে কি করতে হবে সেটা তো আমরা সাধারণ মানুষ বলতে পারবো না।’
যা বললেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা : শুধু ভোটাররাই নন, তাদের থেকে ইভিএম নিয়ে বেশি আস্থাহীনতা কাউন্সিলর প্রার্থীদের। তারা নির্বাচন কমিশনকে প্রচারণা বাড়িয়ে ভোটারদের ইভিএম সম্পর্কে আশ্বস্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মাহমুদুর রহমান টিট বলেন, ইভিএমে ভোট নিয়ে ভোটাররা যারপরনাই আস্থাহীনতায় আছেন। আমরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তার পরও ভোটাররা সেই আস্থাটা পাচ্ছে না। মানুষের সেই আশঙ্কার জায়গাটা কাটছে না।
১৮, ২০ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মহিলা কাউন্সিলর এবং এবারের প্রার্থী জাফরিন ইসলাম রিপা জানান, ‘আমি একজন প্রার্থী হিসেবে পরামর্শ দেবো, সাধারণ জনগণ অনেকেই ইভিএম সম্পর্কে জানি না। কিভাবে ভোট দিতে হবে সেটি জানি না। আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন যদি সাধারণ জনগণকে ভোটের কয়েক দিন আগে থেকে দিকনির্দেশনা দেয়, তা হলে এতে কোনো সমস্যা হবে না।’
জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মতামত : লাঙ্গল প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানান, ‘ইভিএমে অনেক কিছু কারচুপি করার সুযোগ আছে। ভোট র্যাগিং করা, আগেই ভোট পোল করে রাখাসহ অনেক ধরনের সুযোগ আছে। সরকার যদি সেটি এখানে করে তা হলে বুমেরাং হয়ে যাবে। আর ইভিএমের ভোট প্রদানের বিষয়ে রুট লেবেলের মানুষ এখনো সচেতন না। নির্বাচন কমিশন যদি এখনই রুট লেবেলে প্রার্থীদের সহযোগিতা নিয়ে, লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেয়, তা হলে এটি সম্ভব হবে। তা না হলে সম্ভব হবে না। মানুষ ভোট দিতে আসবেও না, পারবেও না। বিষয়টি খুব জরুরি। আমরা এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন।’
আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া জানান, ‘আমার বিশ্বাস, গ্রাম কিংবা আরবান এরিয়ার লোকজন ইভিএম পদ্ধতিকে ভয় করে না। সবাই বিশ্বাস করে আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তিতে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও এগিয়ে যাবে। আগামী ২৭ ডিসেম্বর যে নির্বাচন হবে, সে নির্বাচনেও ভোট সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেবে।’
ডেমো ইভিএম নিয়ে মাঠে জাতীয় পার্টি : উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের জানাতে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা প্রতিদিন ডেমো ইভিএম নিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন। নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডের হাটবাজার, রাস্তায়, রাস্তায়, দোকানপাট, বাসাবাড়িতে দলীয় নেতাকর্মীরা ভোটারদের কিভাবে ইভিএমে ভোট দেয়া যায়, তা হাতে কলমে শেখাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে ইভিএমের ধারণা নিয়েছেন, চা দোকানি রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, ‘আগে তো মুই খুব ভয়োত আইচনু, মেশিন দিয়া কিভাবে ভোট দেইম। জাতীয় পার্টি থাকি ছইলগুলো আসি মোক মেশিনটা নিয়া আসি বুঝি দিচে। একন মুই সঠিকভাবে ভোট দিবার পাইম।’
এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব আনিছুর রহমান আনিছ জানান, ‘আমরা জানি ইভিএম ভালো পদ্ধতি। কিন্তু ইভিএম সম্পর্কে মানুষের ধারণা নেই। এই ধারণা দিতে আমরা আমাদের প্রার্থীদের নির্দেশনায় জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ডেমি ইভিএম নিয়ে এসেছি। এবং প্রতিটি কেন্দ্রভিত্তিক নেতাকর্মীদের মধ্যে তা সরবরাহ করেছি। তারা মাঠে প্রত্যেক ভোটারের কাছে গিয়ে ইভিএমে কিভাবে ভোট দিতে হয়, সেটি দেখাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি আমাদের এই উদ্যোগে বেশ সাড়া পাচ্ছি আমরা। এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।’
রিটার্নিং কর্মকর্তার বক্তব্য : সার্বিক বিষয়ে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন এর রিটার্নিং কর্মকর্তা মো: আবদুল বাতেন জানান, ‘ইভিএম সম্পর্কে ধারণা দিতে আমরা আগামী ২৩-২৪ ডিসেম্বর প্রতিটি পাড়া মহল্লায়, এলাকায় এলাকায় চলে যাবো ইভিএম মেশিন নিয়ে। কাউন্সিলর মেয়র প্রার্থীদের অনুরোধ করব, যেখানে আমরা প্রদর্শনী করব; সেখানে যেন ভোটারদের নিয়ে আসে। তখন তাদের আমরা হাতেকলমে শেখাবো।
কী বলছে সুজন : সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, রংপুর সিটি করপোরেশনের ৭০ ভাগ এলাকাতেই এখন নগর সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি। এখনো ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। ইভিএম সম্পর্কে তাদের ন্যূনতম কোনো ধারণা নেই, বরং তারা আস্থাহীন। তাই এই নির্বাচনে ইভিএমকে মানুষের আস্থায় আনতে হলে এখনই ইভিএম নিয়ে যেতে হবে মানুষের দোরগোড়ায়। তা না হলে মানুষের সন্দেহ দূর হবে না। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে কথায় নয়, কাজে মাঠে থাকতে হবে। এ কাজে কাউন্সিলর ও মেয়র প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করাতে হবে। তা হলে সুফল পাওয়া যাবে।
এরই মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মেয়র পদে ১০, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬৯ এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৯৮ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। ৮ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। ২৭ ডিসেম্বর হবে ভোট গ্রহণ।
রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতর সূত্র জানিয়েছে, এবার ভোটার ও কেন্দ্র সংখ্যা বেড়েছে। এবার স্থায়ী ভোট কক্ষ করা হয়েছে এক হাজার ৩৪৯টি এবং অস্থায়ী ভোট কক্ষ আছে ১৯৩টি। ভোটার সংখ্যা চার লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ১২ হাজার ৩০২ জন এবং নারী দুই লাখ ১৪ হাজার ১৬৭ জন।