ইংলিশ মিডিয়ামে বাংলা : শাপে বর নাকি অমৃতে অরুচি
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের পর পেশা হিসেবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলা পড়াতে যাওয়া কতটুকু ঝুকিপূর্ণ, তা কেবল সংশ্লিষ্টরাই জানেন। তবু চাকরির এই দুর্মূল্যের বাজারে কোনোরকম একটা ক্যারিয়ার করে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাটাই তো বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে এতসব হিসেব-নিকেশের পরও কেউ কেউ স্বেচ্ছায়, সানন্দে তার জীবন ও জীবিকার পথ বেছে নেয়, দ্বিধা না করে এবং দায়িত্ব নিয়ে কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত হয়। দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর ধরে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করছি। আমিও ওই কেউ কেউ এর দলে। তাই কাজকে ভালোবাসি এবং পরম মমত্বে দায়িত্ব পালন করি। অনেক ভণিতা হলো, এবার কাজের কথায় আসা যাক।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসারে দেশে পরিচালিত প্রতিটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকেই বাংলা পড়াতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে এবং ও-লেভেল পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের বাংলা পরীক্ষা দিতে হয়। মূলত ২০১০ এর পর থেকেই দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে ঘটা করে বাংলা শিক্ষক নিয়োগ দেয়া শুরু হয় এবং অবহেলিত এই বিষয়টি ইংরেজি কিংবা গণিত বিষয়ের মতো মর্যাদা লাভ করে।
ইংলিশ মিডিয়াম কারিকুলাম প্রকৃতপক্ষে একটি দারুণ কারিকুলাম। এদেশে মূলত এডেক্সেল ও ক্যামব্রিজ কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীকে ও-লেভেল ও এ-লেভেল সম্পন্ন করার পর সে উচ্চশিক্ষায় যেতে পারে।
ও-লেভেল (অর্ডিনারি লেভেল) আমাদের দেশের মাধ্যমিক সমপর্যায় কিন্তু এখানে শিক্ষার্থী অত্যন্ত স্বাধীনভাবে তার পছন্দের বিষয়সমূহ নির্বাচন করতে পারে এবং শুধু সেগুলোতে পরীক্ষা দিতে পারে। বিষয়গুলোর বইগুলোও অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে, আন্তর্জাতিকভাবে গবেষণা করে তৈরি। কী বিজ্ঞান, কী বাণিজ্য- সকল বিভাগের সকল বিষয়েই ও-লেভেলে প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো পড়ানো হয় যা আতিশয্যে আক্রান্ত নয় আবার ক্ষুদ্রাকৃতিরও নয়। ও-লেভেল এবং এ-লেভেল-এ শিক্ষার্থীর অর্জিত গ্রেড আন্তর্জাতিক পরিসরে পৃথিবীর উন্নত সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই গৃহীত হয়।
ঠিক এই পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থী যখন অনেকটাই বাধ্য হয়ে বাংলা বিষয়টি অধ্যয়ন করে এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তখন সেটা তার কাছে অস্বস্তিকর বা বিরক্তির লাগ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তারা কি এটা বিবেচনা করে যে বাংলা বিষয়টা আসলে তাদের জন্য শাপে বর? বরং তাদের জন্য এটা আসলে অমৃতে অরুচি।
ক্যামব্রিজ কারিকুলামের বাংলা সিলেবাসটা অত্যন্ত ছোট পরিসরে। ব্যাকরণের কয়েকটি ব্যবহারিক বিষয় এবং কিছু রিডিং-রাইটিং-এর বিষয় নিয়ে এই সিলেবাসটি তৈরি। শিক্ষক হিসেবে তাই ইংলিশ মিডিয়ামের বাংলা পড়ানোয় বেশ কিছু স্বাচ্ছন্দ্যের দিক রয়েছে। প্রশ্নপত্র তৈরি, খাতা দেখাসহ পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নে শিক্ষককে বাংলা মিডিয়ামের মতো ঝক্কি পোহাতে হয় না।
অবশ্য প্রতিটি ক্লাস সম্পন্ন করতে তাকে অনেকটাই কষ্ট সহ্য করতে হয় কারণ শিক্ষক এমন কিছু শিক্ষার্থীকে সামনে নিয়ে ক্লাস করেন যেখানে শিক্ষার্থীর বাংলা মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও দ্বিতীয় ভাষার মতো কঠিন মনে হয় এবং তার সঙ্গে আছে বিষয়ের প্রতি প্রবল অনীহা ও অনাগ্রহ।
অবশ্য দিন শেষে অনেক শিক্ষার্থীই পূর্ববর্তী প্রশ্নসমূহ ভালো করে সমাধান করে, কয়েকটি মক পরীক্ষা দিয়ে ও-লেভেল পরীক্ষায় বাংলায় মোটামুটি একটি গ্রেড আনতে সক্ষম হয়। আবার বাংলা গ্রেড নিয়ে শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী, অভিভাবক কোনো পক্ষকেই খুব বেশি মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। কারণ, ও-লেভেল-এর পর বাংলা আর বাধ্যতামূলক বিষয় নয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলার গ্রেড বিবেচ্য নয়।
অথচ এই যে বাংলা বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা হলো এর ইতিবাচক দিকগুলো যেন কারোই চোখে পড়ছে না। সবাই এটিকে অভিশাপের মতোই ভাবছে। আমি বলব বরং এটি শাপে বর।
কারণ, মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো তাকে যখন কোনো কাজ বাধ্যতামূলকভাবে করানো হয় তখন সে ঐ কাজটি দায়িত্ব নিয়ে, যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে আগ্রহী হয় (ব্যতিক্রম রয়েছে অবশ্যই)। প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে বাংলা ভাষায় ন্যূনতম পারদর্শিতা থাকা প্রয়োজন। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ব্যক্তি যত বেশি ভাষা জানেন, তার স্মৃতিশক্তি তত দীর্ঘস্থায়ী ও প্রখর।
আন্তর্জাতিক পরিসরে ইংরেজিতে অধ্যয়ন, যোগাযোগ ও কর্মক্ষেত্রে বিচরণ করতে গিয়েও একজন ব্যক্তি যদি তার নিজ ভাষায় দক্ষ হয়ে থাকেন তবে সে অতিরিক্ত কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। এমন শিক্ষার্থী খুব কমই পাওয়া যায় যে বাংলায় খুব ভালো কিন্তু অন্যান্য বিষয়গুলোতে খারাপ। বরং এমনটা অধিক যে, যে বাংলা ভালো পারে, সে অন্যান্য বিষয়গুলোতেও দক্ষ। বর্তমান বাংলাদেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
যাদের বাবা, মা এবং পরিবারের অনেক সদস্যই বাংলা মিডিয়ামের শিক্ষার্থী ছিলেন। শিক্ষার্থী নিজেও সবসময় বাংলা ভাষাভাষী পরিসরে জীবন-যাপন করে, কেবল অধ্যয়নের মাধ্যম হিসেবে সে ইংরেজিকে বেছে নিয়েছে। সেক্ষেত্রে ঐ শিক্ষার্থী প্রকৃতপক্ষে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যা দেখে, যা ভাবে- তার প্রায় পুরোটাই বাংলা ভাষায়। অর্থাৎ শিক্ষার্থীর চিন্তন প্রক্রিয়া, আবেগ-অনুভূতি, বুদ্ধিমত্তা সবই বাংলায় গড়ে উঠেছে।
এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো বিষয়ের মূল সারসত্য উপলব্ধি করতে, আত্মস্থ করতে শিক্ষার্থী অবচেতনভাবেই বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করে। যেমন- শিক্ষার্থী যখন ফিজিক্স কিংবা কেমেস্ট্রির কোনো জটিল বিষয় অধ্যয়ন করে, বুঝতে চেষ্টা করে, আত্মস্থ করতে চেষ্টা করে তখন তার ব্রেন মূলত অনুবাদের আশ্রয় নিয়েই মূল বিষয়টি বুঝে নেয়।
তাহলে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে এই যে বাংলা বিষয়টি আসলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের একজন শিক্ষার্থীর অন্যান্য বিষয়গুলোকে ভালোভাবে আত্মস্থ করার একটি সহায়ক বিষয়। বাংলাকে তাই বাধ্যতামূলক করায় সেটা তাদের জন্য শাপে বর হয়েছে। অথচ নিছক আগ্রহের অভাবে, চর্চার অভাবে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে কঠিন ও দুর্বোধ্য। তাদের কাছে ব্যাপারটা অমৃতে অরুচির মতোই।
লেখক- সুব্রত দত্ত
শিক্ষক
তেজগাঁও, ঢাকা।