আসন্ন বাজেট এবং শিক্ষা খাতের বরাদ্দ
সরকারের অর্থ ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে বাজেট। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৯ জুন, ২০২২ জাতীয় সংসদে ঘোষিত হবে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট। এটি হবে বাংলাদেশের ৫১তম পূর্ণাঙ্গ বাজেট। প্রতিটি বাজেট তৈরি করার ক্ষেত্রে মৌলিক উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে একটি হলো—দুর্বল খাতে বিনিয়োগ করে সেই খাতকে শক্তিশালী করে তোলা। বাংলাদেশের বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাত অন্যতম। জাতীয় জীবনে শিক্ষার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলে অভিহিত করা হয়েছে। শিক্ষা জাতির উন্নতির অন্যতম পূর্বশর্ত।
দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন অনেকাংশেই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। যথাযথ শিক্ষাজ্ঞান ছাড়া কৃষি, সেবা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন যে খাতই হোক না, সেটার গুণগত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। কিন্তু প্রত্যাশিত মানের শিক্ষা অর্জনের জন্য সার্বিক যে ইতিবাচক পরিবেশ প্রয়োজন, তা থেকে বাংলাদেশ এখনো বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এবং তাদের জন্য শিক্ষার প্রত্যাশিত মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ অন্তরায় রয়েছে। এরমধ্যে সব চাইতে বড় অন্তরায় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ। উন্নত দেশগুলো উন্নয়নের পেছনে তাদের বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দের একটা বড় ধরনের অবদান রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ অথবা জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ১৩-১৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও জিডিপি মাত্র ২.৮ শতাংশ। এতে দেখা গেছে—জাতীয় বাজেটের হিসাবে বা জিডিপি উভয় ক্ষেত্রে আমাদের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে কম। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজেটের আকার বড় করলেও শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বেশ কম। দেশের শিক্ষাবিদরা এই অপ্রতুল বরাদ্দকে গুণগতমানের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামগ্রিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে অভিহিত করেছেন। উন্নত দেশগুলো তাদের বাজেট আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়েও অনেক বেশি অর্থাৎ ৩০-৩৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয় শিক্ষা ও গবেষণা খাতে, সেখানে আমাদের দেশে বরাদ্দ দেওয়া হয় মাত্র ১৫ শতাংশ। এজন্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চলমান যুগে যে পরিমাণ দক্ষ ও সৃজনশীল জনবল প্রয়োজন, তা আমরা এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো—জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন মানবসম্পদ সৃষ্টি করা, যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে নিজ নিজ দেশের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারবে। কারণ, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাসমূহ একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে সংযুক্ত যে, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত, দক্ষ, কর্মঠ, প্রগতিশীল ও উদ্ভাবনী চেতনার মানবসম্পদ দ্বারাই এ লক্ষ্যগুলো অর্জন করা সম্ভব। বর্তমান যুগে দক্ষ ও সৃজনশীল জনশক্তি গড়ে তুলতে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তিসমন্বিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধি হচ্ছে না। শিক্ষাখাতে টেকসই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন আর প্রয়োজনের তুলনায় বাজেটের স্বল্পতা বরাবরের মতো হতাশই করছে।
পৃথিবীতে এমন একটা দেশের উদাহরণ পাওয়া যাবে না, যারা জিডিপির ৪ শতাংশের নিচে বরাদ্দ রেখে শিক্ষায় উন্নত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে গবেষণা ও উন্নয়ন নামে আলাদা একটা খাত আছে। যা শিক্ষা খাতের বাইরে। বাজেট স্বল্পতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য হচ্ছে। এজন্য আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। যা প্রমাণ করে দেয় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলেতে উচ্চশিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ও পরিবেশবান্ধব কাঠামোর অপ্রতুলতা রয়েছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী আজ হতাশ আর বেকারত্বের যাঁতাকলে পিষ্ট। বেকারত্বের গ্লানিময় অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আজ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, যা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের পথে অন্তরায়। এছাড়া করোনা অতিমারির ফলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে অবক্ষয় হয়েছে, সে রেশ এখনো কাটেনি। শ্বাসরুদ্ধকর এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার প্রধান পথ শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রেখে দ্রুত সময়ে আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ পরিবেশবান্ধব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে শুধু বাজেটই নয়, পাশাপাশি সময় উপযোগী শিক্ষক তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের মৌলিক ও জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষাপদ্ধতির ওপর পাঠদানে সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়