আসছে বাজেট: কর্মসংস্থান শিক্ষা সুরক্ষা এই তিন চায় মানুষ
ঢাকাঃ আসছে অর্থবছরের জাতীয় বাজেট একটি জটিল পরিস্থিতিতে প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। গত বাজেটে সমস্যা ছিল একটি। এবার তা বেড়ে হয়েছে তিনটি। সেগুলো হলো অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণের ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং কর আহরণ কম হওয়ার কারণে প্রবৃদ্ধির ধারা শ্লথ হয়ে যাওয়া। গতকাল রবিবার রাজধানীর হোটেল লেকশোরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘জনসম্পৃক্ত সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা : নতুন সরকার, জাতীয় বাজেট ও জনমানুষের প্রত্যাশা’ শীর্ষক বাজেট প্রস্তাবনায় এসব কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিরোধীদলীয় উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, সংসদ সদস্য এ. কে. আজাদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডি পরিচালিত জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে এখন ত্রিযোগ সমস্যা হয়েছে অর্থাৎ তিনটি সমস্যা যুক্ত হয়েছে। গত দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলেছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের ঋণের ঝুঁকি বাড়ছে। এ ঋণ শুধু বিদেশি ঋণ না, অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি খাতের ঋণের দায়দেনাও বাড়ছে। তৃতীয়ত, প্রবৃদ্ধির হার শ্লথগতির হয়ে পড়েছে। এটি হয়েছে কর আহরণ কম হওয়ার কারণে, এ খাত না বেড়ে আরও সংকুচিত হয়েছে।’
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বিরূপভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। ফলে বাল্যবিয়েও বাড়ছে। বিশ্বে মূল্যস্ফীতির পতন ঘটেছে, কিন্তু দেশে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।’
জিডিপিতে ঋণের বোঝা আরও বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের যে সুনাম ছিল আমরা কখনো খেলাপি হই না, সে সুনাম আর থাকছে না। ৫ বিলিয়ন ডলারের দেনা এখনো আমরা দিতে পারছি না। আমাদের গর্বের জায়গায় চিড় ধরেছে। জিডিপিতে সরকারি ঋণ ৩৭ শতাংশ, ব্যক্তি খাতের ঋণ ৫ শতাংশ সব মিলিয়ে ৪২ শতাংশ ঋণের বোঝা আছে সরকারের।’
জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হবে জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ‘সরকার ত্রৈমাসিক জিডিপির তথ্য দিচ্ছে। তাতে যা দেখা যাচ্ছে, গড় প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে বাকি সময়ে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব।’
বাজেট প্রত্যাশা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করেছে সিপিডি। এতে আড়াই হাজারের ওপর অংশগ্রহণকারী ছিল। সেই জরিপের তথ্য তুলে ধরে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ৬৪ শতাংশ বলেছে তাদের কোনো বাজেট প্রত্যাশা নেই। এতে তিনটি বিষয় পরিষ্কার। তারা শোভন কর্মসংস্থান চায়, মানসম্মত শিক্ষা চায়, সম্প্রসারিত সামাজিক সুরক্ষা চায়।
এ অর্থনীতিবিদ সরকারের উদ্দেশে বলেন, পিছিয়ে পড়া মানুষের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারকে যুক্ত করতে হবে। আর স্বাধীন গণমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। জরিপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ মানুষ বলছেন, স্বচ্ছতার জন্য পেনশন ফান্ডকে আলাদা করতে হবে, সামাজিক সুরক্ষায় যোগ করা যাবে না।
সিপিডির এ জরিপে দেখা যায়, ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ শোভন কর্মসংস্থান চান। ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ মানসম্মত শিক্ষা চান, ১২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ সম্প্রসারিত সামাজিক সুরক্ষা চান, ৮ শতাংশের বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা, ৭ দশমিক ৬ শতাংশ দক্ষতা উন্নয়ন, ৬ দশমিক ২ শতাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ চান। সবচেয়ে কম মানুষ অর্থাৎ ১ দশমিক ৩২ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনে বিনিয়োগ চান।
সিপিডির জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ নাগরিক বেকারত্ব কমানোর কথা বলেছেন। ৩৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং ১১ দশমিক ০২ শতাংশ বেকারভাতা চালুর পক্ষে মত দেন।
নাগরিকদের দ্বিতীয় শীর্ষ প্রত্যাশা হিসেবে রয়েছে শিক্ষা। ৪৯ দশমিক ৭২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, তারা মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ চান। আর বৃত্তি/শিক্ষাভাতা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তা চান।
জাতীয় বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেছে সিপিডির জরিপ। দেশের সব নাগরিকের চাহিদার প্রতি বাজেট যেন ন্যায়সংগত ও প্রতিক্রিয়াশীল হয়, সেজন্য এটি অপরিহার্য বলে মনে করে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির বাজেট প্রস্তাবনাগুলোকে একত্র করে এই নথি প্রস্তুত করা হয়েছে। পরিতাপের বিষয় এই যে, দেশের ঐতিহ্যগত বাজেট প্রস্তুতির প্রক্রিয়ায় সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি/মতামত প্রতিফলনের সুযোগ খুবই সীমিত।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিরোধীদলীয় উপনেতা ও সাবেক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এমনকি শ্রীলঙ্কাও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশ তা পারছে না, প্রায় দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। আসলে ভোগ্যপণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘১০ শতাংশের কাছাকাছির উচ্চ মূল্যস্ফীতি গত দুই বছর ধরে জনগণকে ভোগাচ্ছে। অথচ ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশ ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। দেশে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির অন্যতম কারণ হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের বাজার মাত্র পাঁচ থেকে ছয়জনের নিয়ন্ত্রণে থাকা। এ সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। এ সিন্ডিকেট অনেক ক্ষমতাধর। মাত্র ছয়-সাতটি কোম্পানি নিত্যপণ্য আমদানি করে। তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের লাইব্রেরি কমিটির সদস্য এ. কে. আজাদ বলেন, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এসব অর্থের যথাযথ ব্যবহারের পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত সব মন্ত্রণালয় এবং বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করা না যাবে, ততদিন পর্যন্ত বরাদ্দ বাড়িয়েও কোনো কাজে আসবে না। সব মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহিতার আওতায় না আনলে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’
নিজের নির্বাচনী এলাকার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘একটি রাস্তা সংস্কারের জন্য স্থানীয় প্রতিনিধির ৩ লাখ টাকা দাবির বিপরীতে ১ লাখ দিতে চাইলেও ওই প্রতিনিধি নিতে চাননি। তবে পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই রাস্তা ৩০ হাজার টাকা দিয়েই সংস্কার সম্ভব। সরকারি টাকার এ ধরনের অপচয় রোধের পাশাপাশি নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালকেও দুর্নীতিমুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, উন্নয়ন অবকাঠামো খাতে বরাদ্দে বাড়লেও গুরুত্ব কমছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের মতো সামাজিক খাত, যা দ্বিতীয় প্রজন্মের বড় সমস্যা। সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধ ও সুষম বণ্টনের গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তারা বলেন, রেওয়াজ অনুযায়ী অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হলেও বাজেট তৈরিতে গুরুত্ব পায় সুবিধাভোগী (প্রেশার গ্রুপের) শ্রেণির সুপারিশ। অনেক দিন থেকে বিশৃঙ্খলায় আর্থিক খাত। অর্থ পাচার বাড়িয়েছে সংকট। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে বাগে আনতে দরকার সুশাসন আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জোরালো গুরুত্ব উঠে এসেছে আলোচনায়।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০৬/০৫/২০২৪