আমার হাত চলে না, পাও চলে না করি কী উপায়
নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
আর আমার দেহ চলে না রে দয়াল
আমার হাত চলে না, পাও চলে না
করি কী উপায়...
গানের কথায় দেহ না চললেও কাঙালিনী সুফিয়ার এই গান শুনে যে কারোরই দেহ দুলবে। একটা সময় মঞ্চে এমন জনপ্রিয় গান গেয়ে শ্রোতা মাতিয়েছেন এই শিল্পী। এখন যেন নিজের গানের কথাই ফলেছে কাঙালিনী সুফিয়ার জীবনে। গানের কথার মতো এখন তার হাত চলে না, পা চলে না। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কাঙালিনীর দেহটাই যেন আর চলতে চায় না! ৭৫ বছর বয়সী এই শিল্পী আজ তার গানের মতোই পথহারা।
গানে যেমন নিতাইগঞ্জে যাওয়ার পথ খুঁজেছেন, জীবনের এই পর্যায়ে এসে তার একই অবস্থা। অর্থাভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন কাঙালিনী। নিজের জন্য ওষুধ পর্যন্ত কিনতে পারছেন না। যে নাতনি একটু সহযোগিতা করতেন, এই দুর্দিনে সেই নাতনির চাকরির মেয়াদও শেষ পর্যায়ে। দুই বছর ধরে বেতন না পাওয়ায় ঋণ করে সংসার চালাতে হচ্ছে।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার রামদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাঙালিনী সুফিয়া। বার্ধক্য জেঁকে বসেছে তার দেহে। এখন ভালো করে কানেও শোনেন না। কখনও কখনও লাঠিতে ভর দিয়ে চলেন। গলার সেই তেজ আর নেই। বর্তমানে তার সঙ্গে থাকেন মেয়ে পুষ্প।
কাঙালিনী সুফিয়া জানান, তার নিজস্ব কোনো জায়গা-জমি ছিল না। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে গান গেয়ে বেড়াতেন। ২০১৪ সালে রাজবাড়ীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক হাসানুজ্জামান কল্লোল সদর উপজেলার কল্যাণপুরে ২০ শতাংশ জমি দেন তাকে। সেখানে কাঙালিনী সুফিয়া একাডেমি করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পর ডিসি রফিকুল ইসলাম ওই জমিতে ঘর করে দেন। তারপর আর কিছুই হয়নি।
সে সময় ডিসি রফিকুল ইসলামকে ধরে নাতনি শিল্পীর একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন কাঙালিনী। পরে জানতে পারেন সেটি অস্থায়ী নিয়োগ। নাতনি শিল্পী দুই বছর ধরে বেতন পান না। শুনছেন চাকরির মেয়াদও শেষ পর্যায়ে।
এই বাউলশিল্পী জানান, দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে কোথাও গান গাইতে পারছেন না। আগে গান গেয়ে টাকা রোজগার করতেন। এখন সে উপায় নেই। শরীরে নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে। সেভাবে চলতেও পারেন না। মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয় তাকে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মাসে যে ১০ হাজার টাকা পান সেটা দিয়ে ওষুধের ব্যয়ই মেটে না। তিনি তার নাতনির চাকরি স্থায়ী করার আবেদন জানিয়েছেন।
নাতনি শিল্পী আক্তার জানান, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি কালুখালী উপজেলার ভূমি অফিসে নৈশপ্রহরী পদে নিয়োগ পান। তবে তিনি ডেপুটেশনে কালুখালী ইউএনও অফিসে দিনের বেলায় দায়িত্ব পালন করতেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়মিত বেতন পেয়েছেন। তারপর আর বেতন পাননি। পরে তাকে জানানো হয়, বেতন আটকে গেছে। ২০২০ সালে এসে জানতে পারেন তাকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যার মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বেতন পাবেন এই আশায় ধারদেনা করে সংসার চালিয়েছেন। তার তিন সন্তান। তাদের পড়াশোনার খরচ আছে। এখন তিনি দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম বলেন, 'কাঙালিনী সুফিয়া আমার কাছে এসেছিলেন। তার সমস্যার কথা জানিয়ে একটি লিখিত আবেদন দিতে বলেছি। সেটা দিলে তিনি কী চাচ্ছেন তা দেখে আমরা ব্যবস্থা নেব। আর ওনার নাতনি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছে। সেটা সরকারি নীতিমালা অনুযায়ীই চলবে। এখানে আমার আলাদা করে কিছু করার সুযোগ নেই।'
মাত্র ১৪ বছর বয়সে সংগীত জীবন শুরু কাঙালিনী সুফিয়ার। তার রচিত গানের সংখ্যা প্রায় পাঁচশ। নিজে পড়াশোনা জানেন না। এ কারণে মুখে বলে অন্যকে দিয়ে গান লেখান তিনি। চলচ্চিত্রেও তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। এ পর্যন্ত ৩০টি জাতীয় এবং ১০টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন এই শিল্পী।