আমার ঘরে আমার স্কুল এবং প্রাসঙ্গিক কথা
বিশ্বব্যাপী নভেল করোনা ভাইরাসের মহামারীর কারণে কার্যত পুরো বিশ^ই এখন থমকে আছে। প্রতিদিনকার সব কাজ এখন বন্ধ। এখন কেবল নিজেদের রক্ষা করার সময়। এখন চ্যালেঞ্জ হলো করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে নিজেকে এবং বিশ^কে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা এখন নিজেদের ঘরবন্দী করে রাখছি।
এখন স্কুল কলেজ সব কিছু বন্ধ রয়েছে। মূলত করোনা ভাইরাস যখন থেকে তার ভয়ংকর রুপ দেখাতে শুরু করে তখন থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়। আমাদের দেশেও শিশুদের মাঝে যাতে এই ভাইরাস ছড়িয়ে না পরতে পারে সেজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যে সময়টা আপনার আমার সন্তান স্কুলে হেসেখেলে পার করতো সেই সময়টাই এখন তারা পার করছে বাড়িতে বসে।
নিজেদের কথার পাশাপাশি এই সময়টা তারা কিভাবে পার করছে, তাদের ভেতর আতংক আছে কি না তার খোঁজ রাখতে হবে। তবে তাদের সময়ের ব্যবধানে লেখাপড়াই একটি বাধা তৈরি হয়েছে। এই বাধা কবে সরে যাবে তাও একেবারে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। আবার স্কুল বন্ধ মনে করে একেবারে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলেও চলবে না। কতৃপক্ষের উদ্যোগে তাই এটুআই এর সহযোগীতায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) টেলিভিশনে ক্লাস চালু করেছে। ছাত্রছাত্রীরা যাতে পিছিয়ে না পরে, বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে যেন লেখাপড়া থেকে দূরে না সরে যায় সেজন্যই আমার ঘরে আমার স্কুল নামের এই ব্যবস্থা।
সকাল নয়টা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত এই ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। পরবর্তীতে তা আবার পুনঃপ্রচারও করা হচ্ছে। এসবই হচ্ছে ছাত্রছাত্রীর কল্যাণের কথা চিন্তা করে। নিঃসন্দেহে কতৃপক্ষের এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। এই আইডিয়াটা অভূতপূর্ব!
আমি জানি না অন্য দেশে এভাবে ছাত্রছাত্রীদের কথা চিন্তা করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ক্লাস করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে কি না। তবে আমাদের দেশে এই পদ্ধতি চমকপ্রদ। কিন্তু প্রশ্ন হলো এর সফলতা নিয়ে? অর্থ্যাৎ এতে ছাত্রছাত্রীরা প্রকৃতপক্ষে কতটা উপকৃত হচ্ছে? আর যারা উপকৃত হচ্ছে সেই হার কত?
আমাদের লক্ষ রাখতে হবে টেলিভিশনে ক্লাস নেয়ার বিষয়টা সেই শহর থেকে গ্রাম সব স্তরের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যেই নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কতজন শিক্ষার্থী প্রকৃতপক্ষে এই ক্লাস মনোযোগ সহকারে টেলিভিশনের পর্দায় দেখছে এবং তা বাস্তবায়ন করছে। আমাদের এই পরিকল্পনা স্বার্থক করে তুলতে হবে।
কারণ কতদিনে শিক্ষা কার্যক্রম আগের অবস্থায় ফিরবে তা সময়ই বলে দেবে। আপাতত এই ব্যবস্থা শ্রেণি পাঠদানের বিকল্প হিসেবে উপযুক্ত করে তোলার প্রয়াস করতেই হবে। এই কার্যক্রমের সফলতার জন্য কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা আলোচনার দাবী রাখে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে শহর ও গ্রামের অভিভাবক সচেতনতা। শহরের অভিভাবকরা সচেতন হলেও গ্রামে সেই হার কম।
তাদের আর্থিক অবস্থা, পারিপাশি^ক সমাজ ব্যবস্থা এজন্য দায়ী থাকে। ফলে শহরের ছাত্রছাত্রীরা টেলিভিশনে ক্লাস করার সুযোগ গ্রহণ করলেও গ্রাম পর্যায়ে কতজন শিক্ষার্থী এ সুযোগ নিতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দ্বিতীয়ত. আমাদের দেশে চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে শিক্ষক সামনে থেকে শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেখানে তাকে শ্রেণিতেই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে নানা রকম প্রচেষ্টা করতে হয়। ফলে বাড়িতে টেলিভিশনের পর্দায় বসে ক্লাস করার সময় তাদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারবে এই সংখ্যা যে বেশি হবে না এটা বলাই যায়।
তবে এখানে একটি বিষয় যে, সেই সংখ্যা যাই হোক না কেন সেটাও কিন্তু আমাদের বেশ কাজে দেবে। বিশেষত যখন করোনার প্রভাবে সবকিছু বন্ধ। তখন বিকল্প হিসেবে দক্ষ শিক্ষকদের দিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়ার একটি মহৎ প্রচেষ্টার বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব রয়েছে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের।
অন্তত এই দুইজনের সংশ্লিষ্টতা এখানে একান্ত প্রয়োজন। বছরের অন্যান্য সময় আমাদের শিক্ষার্থীদের একটি বড় সময় থাকে লেখাপড়া করে দিনের সময় পার করা। কিন্তু ঘরে বসে থেকে সবসময় সেই কাজটিও করে যাওয়া সম্ভব হবে না। লেখাপড়া একটানা কার ভালো লাগে! তবে পড়তে তো হবেই। একটি সুন্দর পড়ার রুটিন তৈরি করে সেখানে আপনার সন্তানকে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করাতে পারেন। এমনভাবে তা করতে হবে যেন তা তার মনের ওপর কোনোভাবেই চাপ তৈরি না করে। তাকে বোঝাতে হবে এই সময়ে আমাদের ঘরে থেকে সব কাজ করাটাই নিরাপদ।
আর শিশুরা বোঝাতে পারলে অবশ্যই বুঝতে পারবে। তার লেখাপড়ার অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। প্রতিদিন টিভিতে যে ক্লাসগুলো নিচ্ছে সেগুলোর অগ্রগতি আপনি দেখতে পারেন। তাকে প্রতিদিন এই ক্লাসগুলোতে মনোযোগ দেয়ার ব্যপারে উৎসাহ দেবেন। যাতে সে ক্লাসে যেভাবে প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন নোট করতো এবং বাড়ির কাজ খাতায় তুলে আনতে এবং পরের দিন আবার সেই কাজ তৈরি করে শিক্ষককে দেখাতো।
ঠিক সেভাবে সে বাড়ির কাজ তৈরি করবে এবং তা মিলিয়ে নেবে।
দেখবেন প্রথমে সংকোচ থাকলে পরে সে বিষয়টিকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। তাকে লেখাপড়ার নতুন নতুন কৌশল সম্পর্কে শেখাতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় লেখাপড়াটাকে চাপ না মনে করে তাকে উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে তাতে অভ্যস্থ করা যায় কি না তার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন প্রাইভেট বা কোচিং ও শীট নির্ভর লেখাপড়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এতে প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হবে।
কারণ এখানে কেউ শীট দেবে না। প্রত্যক্ষ মূল্যায়ণও কেউ করবে না। তবে যদি কেউ চেষ্টা করে সে অবশ্যই তা করতে পারবে। প্রতিদিন যে ক্লাসগুলো হচ্ছে তা ভালোভাবে আয়ত্ত¡ করার চেষ্টা করতে হবে। হোমওয়ার্কগুলো প্রতিদিন করতে হবে এবং মিলিয়ে নিতে হবে। এখানে অভিভাবকের বড় ভূমিকা রয়েছে। রয়েছে শিক্ষকের ভূমিকা। প্রতিদিনের কাজ তারিখ অনুযায়ী লিখে রাখতে হবে। সরকারের এটি মহৎ একটি উদ্যোগ। হতে পারে এটি চিরাচরিত প্রক্রিয়ার মতো নয়। তবে এই সময় এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে। যেখানে সবাইকে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজার রেখে চলতে হচ্ছে। সেখানে এই পদ্ধতিতে লেখাপড়া শিক্ষার্থীকে এগিয়ে রাখতে পারবে।
লেখক- অলোক আচার্য
শিক্ষক ও কলাম লেখক
পাবনা।