দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তা
‘আমরা পড়াশোনা করতে চাই কিন্তু স্কুলই তো নেই’
শিক্ষাবার্তা ডেস্কঃ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন। মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। শিশুরা যুক্ত হচ্ছে জেলে পেশায়। বিদ্যালয়ের অভাবে নিরক্ষরতা ও শিশু শ্রম বাড়ছে। ফলে শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। দ্রুত একটি মাধ্যমিক স্কুল স্থাপনের দাবি এলাকাবাসীর।
জানা গেছে, ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার পুরো দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৩ সালে দ্বীপটি নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন হতে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র ইউনিয়নের মর্যাদা লাভ করে। প্রায় ৬০ হাজার জনসংখ্যার নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নে রয়েছে মাত্র একটি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল। বিদ্যালয়ের অভাবে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকের আগেই ঝরে পড়ছে শিশুরা।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পিছিয়ে আছে নিঝুম দ্বীপ। স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার সুযোগ রয়েছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা। মূল হাতিয়া অথবা নোয়াখালী-চট্রগ্রামে শিক্ষার জন্য পাঠানো সম্ভব হয় না বেশিরভাগ পরিবারের। ফলে নিজ ইউনিয়নে মাধ্যমিকের সুযোগ না থাকায় এরপর শিশুরা জেলে কাজে জড়িত হয়ে যায়।
নিঝুম দ্বীপের মফিজা খানম নূরানী মাদরাসায় ৩য় শ্রেণিতে পড়েন মো. আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, আমাদের এখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত মাদরাসা শিক্ষা রয়েছে। বর্তমানে আমি ৩য় শ্রেণিতে আছি। আমার বাবা একজন জেলে। যেহেতু চতুর্থ শ্রেণির পর মাদরাসায় আর পাঠদানের সুযোগ না থাকায় বাবার পেশায় যুক্ত হতে হয়। আমার পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে ইচ্ছে পূরণ হবে না।
একই মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণির রত্মা আক্তার, সালমা আক্তার ও সুমাইয়া আক্তার নামের তিনি শিক্ষার্থী বলেন, চতুর্থ শ্রেণির পর আর পড়াশোনা না থাকায় আমরা বাড়িতেই থাকতে হয়। বাবা-মা আমাদের দিয়ে মাছের কাজ করায়। বড়দের দেখেছি চতুর্থ শ্রেণি পার হলে বিয়ে দিয়ে দিতে। আমাদের ভাগ্যে কী আছে জানি না। আমরা পড়াশোনা করতে চাই কিন্তু স্কুলই তো নেই। তাই সেই সুযোগও আমাদের নেই।
নিঝুম দ্বীপ নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. আল আমিন বলেন, সবার সামর্থ্য সমান না। অনেকেই এইট পাস করার পর মূল হাতিয়ায় অথবা চট্রগ্রামে গিয়ে পড়াশোনা করে। অনেকের ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ হয়। তারপর কর্মের জন্য নদীতে চলে যেতে হয়।
মোহাম্মদ রাসেল নামের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, আমার মামার বাড়ি মূল হাতিয়ায় হওয়ায় সেখান থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেব। সেখানে খাওয়া-থাকাসহ নানান অসুবিধায় পড়তে হয়। জেলে পরিবারের সন্তান তাই বাবা সব চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। কিন্তু নিঝুম দ্বীপে যদি মাধ্যমিক স্কুল থাকতো তাহলে আমার এত কষ্ট করতে হতো না। অন্তত এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত নিজের বাড়িতে থেকে দিতে পারতাম।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে জেলে পেশায় যুক্ত হওয়া মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় আমরা জেলে পেশায় যুক্ত হয়েছি। যদি বড় মাদরাসা অথবা স্কুল হয় তাহলে অন্তত আমাদের সন্তানরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হবে না। আমাদের মতো সবার জীবন অন্ধকার হোক আমরা চাই না। শিক্ষার আলো চাই।
নিঝুম দ্বীপের বাসিন্দা আইয়ুব আলী বলেন, আমার পরিবারের সামর্থ্য ছিল বলে আমি ঢাকায় গিয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করতে পেরেছি। এখানে সবাই নদীর সঙ্গে যুক্ত তাই সবার সন্তানকে বাইরে শিক্ষার জন্য পাঠাতে পারে না। তবে যদি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হবে না। পুরো নিঝুম দ্বীপ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে।
মো. হাসিব নামের এক যুবক বলেন, আমাদের এখানে যদি হাই স্কুল থাকতো তাহলে ছেলে-মেয়েরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারতো। আমাদের এখানে অনেক পর্যটক আসেন তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার মতো শিক্ষাও এখানে নেই।
আনোয়ার হোসেন নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, এটি নদীমাতৃক এলাকা। অনেক মেধাবী ছেলে মেয়ে রয়েছে কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে তারা ঝরে পড়ছে। প্রতি বছর অষ্টম শ্রেণির পর ৮০ থেকে ৯০ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। আর্থিক অবস্থার দুর্বল হওয়ায় বাইরে গিয়ে পড়ার সুযোগ তাদের হয় না।
মো. শাহিন খান নামের এক মাদরাসা শিক্ষক বলেন, মাছের সময় আসলে স্কুল মাদরাসায় শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই জেলে পেশায় যুক্ত হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠান চালাতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। কিছু মাদরাসা থাকলেও স্কুলের সংখ্যা কম হওয়ায় শিক্ষার আলো থেকে বেশিরভাগ মানুষ বঞ্চিত। জেলেদের নিজেদের ভালো বুঝতে হলেও শিক্ষার প্রয়োজন আছে। নিজেদের জীবন সম্পর্কে সতর্ক হতে হলেও শিক্ষার প্রয়োজন আছে।
নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের শতফুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোজাক্কের হোসেন রতন বলেন, যারা সুযোগ পেয়েছে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ ভালো পেশায় যুক্ত হয়েছে। নতুন বসতি পূর্ণ এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নেই। জনসংখ্যা হিসেবে যা আছে তা খুবই অপ্রতুল। পড়ালেখার সুযোগ না থাকায় শিশুরা জাল ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে।
নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আফছার দিনাজ বলেন, শিক্ষার আলো থেকে নিঝুম দ্বীপ অনেক পিছিয়ে। জনগণ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক কমে। ফলে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী ঝরে পড়ছে। তারা জেলে কাজে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। পর্যটন এলাকা হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার। অন্তত আরও দুই/তিনটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজন। একটি মাধ্যমিক স্কুলের প্রয়োজন। তাহলে অন্তত শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুটা পরিবর্তন হবে।
হাতিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুব মোর্শেদ লিটন বলেন, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী আছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলটিকে জাতীয়করণ করেছেন। আমরা চাই এই স্কুলটিকে মাধ্যমিক স্কুল হিসেবে অনুমোদন দিতে। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি। গরিব মানুষগুলো যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খুব প্রয়োজন।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম হোসেন বলেন, নিঝুম দ্বীপ শিক্ষার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এখানে কিছু অবকাঠামোগত প্রতিকূলতা রয়েছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য এখানে শিক্ষা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। একটি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুব প্রয়োজন। জেলা প্রশাসক স্যারসহ স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হবে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ফেরদৌসী বেগম বলেন, নিঝুম দ্বীপ মূল হাতিয়ার বাইরে হওয়ায় সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ। সেখানকার মানুষের আর্থিক অবস্থা নাজুক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও স্থানীয় শিক্ষিত মানুষ না থাকায় অন্য স্থান থেকে শিক্ষকদের যাতায়াত করতে হয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। জনসংখ্যা হিসেবে যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম হয় তাহলে আমরা ঊর্ধ্বতনদের কাছে দাবি জানাব। আশা করি এক্ষেত্রে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হবেন। সুত্রঃ ঢাকা পোষ্ট
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৯/০২/২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে পেজে লাইক দিয়ে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়।
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
এই বিভাগের আরও খবর