আমতলা থেকে শ্রেণিকক্ষে যেতে চায় ওরা
আমাদের অফিস গত দু’মাস থেকেই খোলা। শ্রেণিকক্ষগুলো বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন উচ্চতর শ্রেণির ভাইভা, সেমিনার ছাড়াও বড় বড় অফিসিয়াল সভাগুলো সদস্যদের সরাসরি উপস্থিতির মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রথমদিকে সভায় সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং চা-কফি খাওয়া নিয়ে কারও কারও আপত্তি থাকলেও এখন বাইরের খাবারে কারও কোনো আপত্তি নেই। যদিও কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে সতর্কবাণী রয়েছে, তথাপি এ নিয়ে কারও কোনো গভীর মাথাব্যথা নেই।
গত সপ্তাহে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই আমাকে দেখে বেশ ক’জন একসঙ্গে দৌড়ে গাড়ির কাছে চলে এলো। ওরা আমগাছের গুঁড়িতে সিমেন্ট বাঁধানো গোলচত্বরগুলোতে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আমাদের ক্যাম্পাসে শ্রেণিকক্ষের সামনেই আমবাগান। সেখানে একেক গাছের গোড়ায় একেক বিভাগের নাম লেখা বিশ্রামের জায়গা লক্ষণীয়। বিভিন্ন মেলা ও সামাজিক অনুষ্ঠানের সময় তারা সেগুলোতে নকশা আঁকে, স্টল তৈরি করে মজা করে থাকে। গরমের সময় সেখানে কেউ কেউ বসে পড়াশোনা করে।
অতিমহামারী কোভিড-১৯ তাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এতদিন ধরে। তবে আর কত? ঘরে কতদিন বসে থাকা যায়? দূরের শিক্ষার্থীরা অনেকেই নিজ নিজ মেসে চলে আসতে শুরু করেছে। শহরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ হচ্ছেই। নিকটবর্তী জেলাগুলো থেকে অনেকেই প্রতিদিন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে এসে ওদের সঙ্গে দেখা করছে, পড়াশোনা-চাকরির আবেদন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছে, মতবিনিময় করছে। এজন্য ক্যাম্পাসের আমতলার নির্দিষ্ট ঠিকানা তাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শ্রেণিকক্ষগুলো তালাবদ্ধ, তাই সহজ ও নিরাপদ আমতলার ঠিকানায় প্রতিদিন ওদের ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে।
সালাম বিনিময়ের পর ওদের প্রায় সবার প্রশ্ন- স্যার, আমরা কবে যাব শ্রেণিকক্ষে? অনলাইনে সবার সুযোগ ও সামর্থ্য নেই, ভার্চুয়াল পড়া বুঝতে কষ্ট হয় স্যার! নিয়মিত অফিসে বসি সেটি জানতে পেরে অনেকে পড়াশোনা ও গবেষণার ব্যাপারে নানা বিষয় জানার উদ্দেশ্যে সরাসরি দেখা করার জন্য সময় চেয়ে নিচ্ছে।
অফিস শেষে আমার এক আত্মীয়কে দেখার জন্য হাসপাতালে সেদিন যাই। তার বয়স্কাবস্থায় বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়ায় ভোররাত পর্যন্ত সেখানে থেকে যেতে হয়েছিল। যদিও তিনি কোভিডমুক্ত; তথাপি কোভিডের এ কঠিন সময়ে নিকটাত্মীয়রা রোগীদের দেখা করতে হাসপাতালে যেতে ভয় করেন। এ ক্ষেত্রে তাই মনে হচ্ছে। রাতে ড্রাইভার ও আমরা দু’জন পাশে থেকে তাকে সাহায্য করছি। এক সময় ঝিমুতে ঝিমুতে শিক্ষার্থীদের কথা মনে হল। পরবর্তী ক’দিন রোগী আর হাসপাতাল নিয়ে সময় পার করছি। মাঝে মাঝে একাই বসে সময় পার করতে হতো।
অলস সময়টা কাজে লাগাতে এক সকালে আমতলার শিক্ষার্থীরা ছাড়াও বিভিন্ন বয়স ও ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীরা কে কেমন আছে, কী ভাবছে তা জানার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত টেলিফোন যাচাই করতে মনস্থ করলাম। আমার কাছে সংরক্ষিত ফোন নম্বরের মধ্যেই যোগাযোগ করে তথ্য নিতে থাকলাম। ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরও দু’সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে।
যা জানা গেল তা হল, ঢাকায় বসবাসরত সাত বছরের স্কুলপড়ুয়া এক শিশু গত ছয় মাস বাসার বাইরে না গিয়েও কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে। ওরা ছয়তলার একটি ফ্ল্যাটের পাঁচতলায় থাকে; বাবা ব্যাংকার। বাবার অফিসের একই ফ্লোরে মাসখানের আগে সাতজন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হঠাৎ একদিন তার বাবার জ্বর হল, টেস্টে করোনা পজিটিভ হয়ে বাসার এক কক্ষে কোয়ারেন্টিনে চলে গেলেন। সতর্কতা নেয়ার পরও তার শিশু ও পরিবারের অন্য সদস্যরাও আক্রান্ত হয়েছিল। অর্থাৎ, স্কুলে না গিয়ে বাসায় থেকেও বাচ্চাদের কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার নজির রয়েছে। এভাবে অনেকের বাড়িতে করোনার জীবাণু বয়ে এনেছে অন্য সদস্যরা- যারা প্রতিদিন জীবন-জীবিকার তাগিদে এবং অফিসের কাজে ঘরের বাইরে গেছেন।
আমি টেলিফোনে যেসব ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছি, তার প্রায় অর্ধেকই করোনা পজিটিভ সম্পর্কিত উত্তর প্রদানে দ্বিধা করেছেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অতি পরিচিতজনরাও সংকোচে উত্তর দিয়েছেন। অনেকে কাউকে একথা না বলতে বলেছেন। এজন্য সব তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব হল না। যেটা বলা যায়, করোনা নিয়ে ভীতি ও কুসংস্কারের বেড়াজাল শহরেই বেশি। কারণ, শহরে বসবাসরত উচ্চশিক্ষিত পরিবারের মধ্যেও করোনা পজিটিভ হওয়ার তথ্য বাইরে প্রচার না করার ব্যাপারে অনুরোধ শোনা গেছে। গ্রামে বসবাসরত শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত কারও মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যায়নি। কেউ বলছেন, করোনা শহরের ধনী মানুষের অসুখ। আমাদের গ্রামে ওসব নেই। ওদের গ্রামের বাচ্চারা স্কুলে যেতে না পেরে শুধু মাছ ধরে ও খেলা করে সময় পার করে দিচ্ছে। স্কুল খোলা না থাকায় ওদের সন্তানদের পড়াশোনার বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা না থাকায় বাড়িতে বসে বসে শুধু খাচ্ছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা শুধু বাড়ি থেকে কী কিনবে বলে (মেগা) বারবার টাকা চায় বলে অভিমত দিয়েছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ পার্কে, হাট-বাজারে, রেস্টুরেন্ট, হাতিরঝিলে বেড়াতে গেছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিদিন বাইরে আড্ডা দেয়া ছাড়াও মজা করে হিরো আলমের সিনেমা দেখতে গেছে।
খুব সীমিত এ প্রচেষ্টায় যেটা জানা গেছে তার সংক্ষিপ্তসার হল- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দিলেও বাড়িতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ বন্ধ থাকেনি। কারণ তারা অনেকেই বাড়ি থেকে কোনো না কোনো প্রয়োজনে বাইরে গেছে। বাজার, মসজিদ, পার্ক, রেস্তোরাঁয় যাওয়া, দলবেঁধে মাছ ধরা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা থেমে থাকেনি। কেউ কেউ ধর্ষণবিরোধী মিছিল, ঈদে মিলাদুন্নবী, তাজিয়া মিছিলে অংশ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের শিক্ষার্থীরা এখনও সিটে ফিরতে না পারলেও অনেকে বন্ধুদের মেসে উঠে গেছে। ক্লাসে ঢুকতে না পারলেও অনেকে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করছে, আমতলায় আড্ডা দিতে জড়ো হচ্ছে। আমতলা আর ভালো লাগছে না, শ্রেণিকক্ষে ফিরতে চায় ওরা সবাই।
দেশে এখন সবকিছু খোলা। গণমাধ্যমে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা প্রচারকে মানুষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এ ব্যাপারে কেউ ভীত নন। সবকিছু খুলে দিয়ে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার মধ্যে কী রহস্য তা নিয়ে অনেকে সন্দেহ পোষণ করছেন। আবার এটাকে অনেকে বোকামি ভাবছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফটক খোলা রাখাটা অন্য যে কোনো কাজ চালু করার চেয়ে বেশি ফলদায়ক। শুধু বিশেষ ভীতি ও গুজবকে সামনে রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার জন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবনে নেমে এসেছে চরম হতাশা। অভিভাবকরা এজন্য উৎকণ্ঠিত। এত দীর্ঘসময় প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চা বন্ধ রাখা জাতির ভবিষ্যতের অগ্রগতির পথে বিরাট অন্তরায়। নীতিনির্ধারকদের এ ধরনের অদূরদর্শী ও একপেশে ভাবনা আমাদের জ্ঞানের পরিসীমাকে দিন দিন আরও সংকুচিত করে দিচ্ছে।-যুগান্তর
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান