আতঙ্ক নয়, চাই সচেতনতা
আমিনুল ইসলাম :
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও ঘনীভূত করোনা আতঙ্ক। যত দিন গড়াচ্ছে, করোনা ভাইরাসের হানায় সন্ত্রস্থ হচ্ছে গোটা দুনিয়া। সবকিছু ছাপিয়ে এখন শিরোনাম করোনাভাইরাস। করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত একটি বহুল আলোচিত রোগ। এটি মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন পশু, বিড়াল, উট ও বাদুড়ের মধ্যে দেখা যায়। সাধারণত প্রাণিদেহে সংক্রমিত করোনা ভাইরাসগুলি মানুষকে আক্রান্ত করে না। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস গোটা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। মানুষের অসহায়ত্ব আরো একবার প্রকট হয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা আসলে কতটা অসহায়।
বিশ্ব প্রকৃতির লীলাই বলি আর মানুষ সৃষ্ট কারণ বলি মূলত জীবন এখন সংকটে। তাই বলে এটা মনে করার কোনো কারণ নাই জীবন থেমে গেছে। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার মিডিয়া সবসময় নেগেটিভ বিষয়ে আগ্রহী। এর কারণও আমাদের অজানা না। মিডিয়া কি চায়? তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা গতিপথ নির্ধারণ করে কারা? এগুলো বুঝলেই আপনি উত্তর পেয়ে যাবেন। মিডিয়ার সদার্থক ভূমিকা বা পজেটিভনেসকে আক্রান্ত করে তার বাণিজ্য। আর নিয়ন্ত্রকরা ভালো জানেন কোনটা বাজারে খায় আর কোনটা চলে না। তাই হয়তো পজেটিভ নিউজগুলো সেভাবে আসে না।
আসলে আমেরিকা ব্রিটেনসহ বিশ্বের নানা দেশ অঢেল অর্থ বরাদ্দ করে দিয়েছে করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য। বিজ্ঞানীরা নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন। তাদের ধারণা বেশ কিছু সময় হয়তো লাগবে কিন্তু তারা নিশ্চয়ই এর একটা বিহিত করতে পারবেন। বেরিয়ে আসবে করোনা প্রতিষেধক কোনো ঔষধ বা অন্যকিছু। যেটা মনে রাখা দরকার এক সময় আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া কালাজ্বর এগুলো ছিলো অপ্রতিরোধ্য। কলেরা-টিবিকে মনে করা হতো কোনোদিন ভালো হবার মতো কিছু না। আর আজ? এগুলো সামান্য অসুখ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এদের ভাইরাস পরাস্ত করার নিয়ম ও প্রতিষেধক এখন সর্বত্র সহজলভ্য। সময় দিতে হবে। আর সবুর করতে হবে।
নীচের খবরগুলো পড়ুন। এমন সব শরীর মন কাঁপিয়ে তোলা খবর সুস্থ মানুষও রোগী হয়ে উঠবেন। একটি খবরও অসত্য না। একটিও বানোয়াট বা ভিত্তিহীন না। কিন্তু পরিবেশনের ভেতরেও আতংক আছে। সাবধানতা ততটা নাই। আমি দেশের মিডিয়া খুলে রোজ দেখি এমন খবরে সয়লাব। পাশাপাশি যদি আশা ভরসা আর নিরাময় পাওয়া মানুষের কাহিনি আসতো তা হলে কি ভালো হতো না? ভালো হতো না কি প্রতিটি নিউজ মিডিয়া যদি রোজ মানুষকে শিখিয়ে দিত কি তার করা উচিৎ? তার পরিবর্তে আমরা একতরফা ভয় ও আতংকে মরার মতো খবর দেখছি।
যেখানে বলা হচ্ছে চীনের বাইরে নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তারের মধ্যে ইরান ও ইতালিতে নতুন রোগী ও মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বেড়েছে। এদিকে এক রাতের মধ্যে নতুন ২১ জনের দেহে এই ভাইরাস ধরা পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।এদিকে ইরানে শনিবার নভেল করোনাভাইরাসে নতুন করে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৫ জনে। এদিন এই ভাইরাস সংক্রমণে দ্বিতীয় একজন এমপিরও মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। ইরানে নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজারে পৌঁছেছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কিয়ানুস জাহানপৌর শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ১৬ হাজারের বেশি মানুষের এখন পরীক্ষা চলছে। এদের বাইরে আরও এক হাজার ৬৬৯ জনের অসুস্থতার বিষয়টি ধরা পড়েছে।
এর আগেও নানা ভাইরাসে বিশ্বের মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এদেশে একসময় প্লেগ রোগ মহামারী হয়ে কতো মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। এই সেদিনও বুশ ফায়ারের সময় চারদিকে আগুনের রেশ ধোঁয়ায় ছিলো জীবন অতীষ্ঠ। একেকদিন শ্বাসকষ্ট আর আগুনের আঁচে দগ্ধ প্রকৃতি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। কিন্তু এমন ক্রাইসিস দেখিনি। ক্রাইসিস কি জানেন? চাল, ডাল, রুটি, ময়দা বা খাবারের আগে ফুরিয়ে গেছে টয়লেট টিস্যু। এদেশে বা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষত পাশ্চাত্যে টয়লেটে পানির ব্যবহার নাই। ঘরের কোনো কোনো টয়লেটে পানির কলও নাই। কিন্তু এরমানে এই না যে এরা পানির ব্যবহার জানে না। পানি না থাকলেও নানা উপায়ে সঠিক ব্যবস্থা নেয়ার পদ্ধতি জানার পরও বাজার থেকে সবার আগে টয়লেট পেপার উধাও হয়ে গেছে। ভাইরাল ভিডিওতে দেখলাম শপিং মলে দুই তিনজন রমনীর ঝগড়া। কে আগে টিস্যু কিনবেন এ নিয়ে হাতাহাতির উপক্রম। করোনার কি এমন প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত? না এর কোনো ভিত্তি আছে? সভ্য সমাজকে অসভ্য ও উগ্র করে তোলার বাণিজ্য বুদ্ধি সব দেশে ব্যবসা বানিজ্যের মন্দার সুযোগ নেবে এভাবে। এটা বলা দরকার ব্যবসা বাণিজ্যের লোকসান আর মন্দা হবেই। সে কারণে বহু জিনিসের দাম বাড়তে পারে, হতে পারে অপ্রতুল। কিন্তু যেখানে সব দেশেই কৃত্রিম সংকট ও ভয় তৈরি হচ্ছে সেখানে আমাদের মতো দেশে কি হতে পারে বলাই বাহুল্য। সামান্য পেঁয়াজ নিয়ে কতো কাণ্ড। ভারতের সংসদে ফলন বেশি আর রপ্তানী করা হবে এমন কথা মুখ থেকে বেরুবার পর কেজিতে নাকি ৩০/৪০ টাকা কমে গিয়েছিল পেঁয়াজের দাম। তাহলে বুঝতে পারেন সংকট আসলে কোথায়?
মোট কথা হলো সর্দি জ্বর কাশি ফ্লু এগুলো ছিল থাকবে। করোনা হলেও হতে পারে বৈকি। কিন্তু মানুষকে আতংকে মারার কোনো কারণ নাই। আপনি হিসেব করলেই দেখবেন লাখো আক্রান্তের ভেতর কতজন বেঁচে আছেন। কারণ তারা সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা ও বিশ্রামে গেছেন। তাই মূল কাজ হলো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। এটা দেশের জন্য জরুরি দুই কারণে। প্রথমত, এত জনবহুল দেশে ধরে ধরে বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সনাক্ত করা অসম্ভব। তা ছাড়া ঠিক কোনো নিয়ম বা শৃঙ্খলাও নাই যার আওতায় বের করা সম্ভব। ফলে মানুষকেই সৎ ভাবে বলতে হবে তার ভালো লাগা ও খারাপ লাগা। দ্বিতীয় কারণ হলো অন্ধত্ব। সভ্যতা আবিষ্কার যেটা যত এগুক না কেন দেশে এসব কোনোদিন বন্ধ হয় না। কাজেই মানুষের সাবধানতা আর আধুনিক মনোভঙ্গিই পারে আমাদেরকে সুস্থ আর স্বাভাবিক রাখতে।
শুভকামনা কিংবা ভালোবাসার ব্যাপার আলাদা। তা থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা নিরাময়ের কোনো ঔষধ বা নিয়ম নয়। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, আত্মবিশ্বাস আর সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি মানুষকে নির্ভার করে। তাই তার আয়ু বা প্রতিরোধ করার শক্তিও বেড়ে যায়। করোনা আতংকে অহেতুক মরার কোনো কারণ নাই। স্লোগান হোক: আতঙ্ক নয়, চাই সচেতনতা
লেখক : আমিনুল ইসলাম
শিক্ষক ও লেখক