আইন শিক্ষার হাতেখড়ি হোক মাধ্যমিক থেকে
আনিকা নাজনীন।।
আমাদের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে আইনের ব্যাখ্যা রয়েছে। সেখানে আইন বলতে অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোনো প্রথা বা রীতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাত্, আইন হচ্ছে এমন কিছু বিধিবিধান, নিয়ম-কানুন যা দ্বারা মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক এমনকি রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক সম্পর্কসহ মানবজীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের আইন এবং বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা হচ্ছে, বিচারব্যবস্থা মূলত পুলিশ, বিচারকবৃন্দ এবং আইনজীবীগণের ওপর ন্যস্ত। প্রকৃতপক্ষে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কেবল পুলিশ, আইনজীবী ও বিচারকের একক দায়িত্ব নয়, একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে।
সংবিধান ও আইন মান্য করতে হলে সংবিধান ও আইন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা নিতান্তই আবশ্যক। আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে আইন জানা থাকলে আইনের আশ্রয় লাভ করা সহজ হয়। অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকলে তবেই অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়া যায়। বাকি সব ক্ষেত্রেও আইনের সঠিক জ্ঞান আবশ্যক। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক মানুষই আছেন, যারা আইনের বিষয়ে সচেতন নন। যদি মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয়, মৌলিক অধিকারগুলো কী কী? সবাই নির্দ্বিধায় জবাব দেবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও শিক্ষা। কিন্তু এগুলো বস্তুতপক্ষে, আমাদের মৌলিক চাহিদা, মৌলিক অধিকার নয়। যেসব অধিকার এর জন্য আমরা রাষ্ট্রের কাছে বা সরকারের কাছে দাবি জানাতে পারি বা যেগুলো পূরণ না হলে আমরা আদালতের শরণাপন্ন হতে পারি সেগুলোই মৌলিক অধিকার।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা—এই চার স্তরে বিভক্ত করা যায়। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় দুটি ধারা-সাধারণ শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষা। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণ, কারিগরি এবং মাদ্রাসা এই তিনটি ধারা রয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কোথাও আইন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার মতো পাঠ্যক্রম চালু নেই।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর ১৫তম অধ্যায়ে আইন শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইন কলেজসমূহের ছাত্রছাত্রীদের বিষয়ে বলা হয়েছে। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে আইন শিক্ষা অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হয়নি।
এমতাবস্থায় শারীরিক শিক্ষা বা চারুপাঠের মতো আইন বিষয়েও একটি পাঠ্যবই থাকা দরকার মাধ্যমিক স্তর থেকে, ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি থেকেই এবং এতে প্রাথমিক, মৌলিক এবং প্রয়োজনীয় আইনগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকবে।
প্রকৃতপক্ষে ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ আরো অনেক বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আইনবিষয়ক কোনো শিক্ষাই প্রদান করা হয় না। অষ্টম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে কিছু মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। বাল্যবিবাহ, যৌতুক, শিশুশ্রম, ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, পরিবেশ দূষণ, সাইবার ক্রাইম ইত্যাদি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হলেও এর শাস্তি সম্পর্কে বলা নেই। আবার এটাও বলা নেই, কোথায় সাহায্য চাইলে তারা উপযুক্ত বিচার পাবে। যেগুলো জানা সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাতে যারা এসব অন্যায়ের শিকার হয়, তারা যেন ভয় না পেয়ে আইনের কাছে সাহায্য চাইতে পারে। আবার যারা এসব অন্যায় করতে দ্বিধা বোধ করে না, তারা যেন অন্ততপক্ষে শাস্তির ভয়ে হলেও বিরত থাকে। অনেক সময় দেখা যায় লাইসেন্স ছাড়া স্কুল-কলেজের ছাত্ররা সর্বোচ্চ গতি সীমার মোটরবাইক চালানোর প্রতিযোগিতা করে। এর শাস্তি ও জরিমানার বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাই নেই। শিশুরা অনেক সময় ভুলবশত বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যায়। কিন্তু তারা আইনের শাস্তির ভয়ে ফিরে আসতে চায় না সঠিক পথে। আবার ৯ বছরের নিচের শিশুর কোনো অপরাধ অপরাধই নয় এই বিষয়ে মানুষ অজ্ঞ এবং বাকি শিশুদের জন্য রয়েছে কিশোর আদালত। কিশোর আদালতে শুধু শাস্তিই নয় পরবর্তীকালে সংশোধন, পুনর্বাসন এবং শিক্ষারব্যবস্থাও রয়েছে শিশুদের জন্য, যা তাদের ধারণারও বাইরে। ফলে আইন শিক্ষার শুরুটা মাধ্যমিক থেকেই হওয়া উচিত।
পরিশেষে শুধু দেশ ও জনগণের উন্নয়নের জন্য আইন তৈরি করলেই হবে না। সাধারণ জনগণেরও প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে জড়িত আইন সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। আর এটি শুধু মাত্র তখনই সম্ভব, যখন আইনকে একটি বিষয় হিসেবে মাধ্যমিক স্তর থেকেই পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ফলে মাধ্যমিক স্তর থেকেই আইন শিক্ষার হাতেখড়ি আবশ্যক।
লেখক :শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়