অলিখিত থেকে যাবে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া আইন!
নিউজ ডেস্ক।।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে বাস ভাড়া বাড়ানোরও ঘোষণা দেয়া হয়, এরপর থেকেই পরিবহনে হাফ ভাড়া নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনা গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। এর মধ্যে ভাড়া নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্থা, সরকারি তিতুমীর কলেজের ৪ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত, ইম্পেরিয়াল কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঝামেলা উল্লেখযোগ্য। ঘটনাগুলো এখানেই থেমে নেই। এরপর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ ও হাফ ভাড়ার দাবি জানিয়েছেন।
আইনগতভাবে হাফ ভাড়ার বিষয়টির কোনো ভিত্তি না থাকলেও ঢাকার গণপরিবহনে এটি একটি চিরায়ত প্রথা। যদিও বাস মালিকেরা সেই প্রথা মানতে চান না। বাসের বাইরে বা ভেতরে লিখে রাখেন ‘হাফ পাস নেই’।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনগত ভিত্তি না থাকলেও হাফ ভাড়া শিক্ষার্থীদের অধিকার। পাকিস্তান শাসনামলে আন্দোলন করেই সেই অধিকার আদায় করেছে শিক্ষার্থীরা। এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকার পক্ষ থেকে আলোচনা হলেও কোনো আইন করার পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
এ মাসের শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে সারাদেশে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই ধর্মঘট পালন করতে থাকেন পরিবহন মালিকরা। অঘোষিত এই ধর্মঘটে তিন দিন কেবল ঢাকার মধ্যে নয়, দূরপাল্লার সব বাসও বন্ধ ছিল। তৃতীয় দিনে গিয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সব ধরনের বাসের ভাড়া ২৬ শতাংশেরও বেশি বাড়ানো হলে ধর্মঘট তুলে নেন বাস মালিকরা। তবে তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। কেননা নতুন ভাড়া নিয়েও যাত্রীদের সঙ্গে বচসা নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের দ্বন্দ্বই বেশি ঘটছে।
এর আগে ২০১৫ সালের অক্টোবরে বিআরটিসির কার্যালয়ে বাস ডিপো ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এক বৈঠকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, রাজধানীতে চলাচলরত বিআরটিসির পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেবে। আর না নিলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এরপর ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলনে তোলপাড় হলো গোটা দেশ। সে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির একটি ছিল, ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে সময়ই মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করলেও সেখানে হাফ ভাড়ার বিষয়টি ছিল না।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও যাত্রীদের অভিযোগ, সিটিং সার্ভিস বা গেটলক নামে দুই থেকে তিনগুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে গণপরিবহনগুলোতে। মানা হচ্ছে না কোনও নিয়ম। ভাড়ার চার্ট দেখতে চাইলেও দেখানো হচ্ছে না। বাসে ওয়েবিলের নামে সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা আদায় করা হচ্ছে। ২৬ শতাংশ বাড়লে সেখানে নতুন ভাড়া হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ১৩ টাকা। সেখানে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কোনো পরিবহনে ২০ টাকার ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। ২৫ টাকার ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৪০ টাকা। অথচ নতুন ভাড়ায় সঠিক হিসাব করলে কোনো কোনো বাসে ভাড়া কমে আসার কথা।
গেটলক সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আদায়ে যাত্রীদের থেকে বাধা পাচ্ছেন বলে গত বুধবার আধাবেলা বাসই নামাননি চালকেরা। শ্রমিকদের দাবি, মালিকদের কাছে সিটিং বা গেটলক সার্ভিস হিসেবেই ভাড়া বুঝিয়ে দিতে হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়ার বেশি দিতে রাজি নন। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে কন্ডাক্টর-চালকের বাকবিতণ্ডা ঘটছে। কোথাও কোথাও হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। ফলে সেখানে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার প্রশ্নই আসে না।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন নেতা–মালিকেরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ভাড়া আদায় করতে গিয়ে শ্রমিক ও সাধারণ যাত্রী–শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি করে দিয়েছেন।
গত ১৫ নভেম্বর উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে জুরাইন রুটে চলাচলকারী রাইদা পরিবহনের বাসে এক শিক্ষার্থী হাফ ভাড়া দিতে গেলে কন্ডাক্টরের রোষানলের শিকার হন। ওই শিক্ষার্থীকে রামপুরা পাওয়ার আগেই জোর করে নামিয়ে দেয়া হয়। পরে ওই শিক্ষার্থী রামপুরা এলাকায় অন্যান্য সহপাঠীদের খবর দিলে শিক্ষার্থীরা অন্তত ৫০টি বাস আটকে রাখে।
পরদিন ১৬ নভেম্বর বিকেলে বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে একজন নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন হেলপার। এ ঘটনার জেরে ১৭ নভেম্বর রাতে ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বাসটি সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের সামনে পৌঁছালে শিক্ষার্থীরা সেটি ভাঙচুর করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়। ঘটনার জেরে কয়েকশ শিক্ষার্থী সদরঘাট, লক্ষ্মীবাজার ও রায়সাহেব বাজার মোড় অবরোধ করে রাখেন।
এ ঘটনার পরদিনই হাফ পাস বাস ভাড়ার দাবিতে বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার রাস্তায় নামেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগে এ সময় বেশ কয়েকটি বাস আটকে রাখে। ফলে ওই এলাকায় যান চলাচলে সাময়িক বিঘ্ন ঘটে। পরে ঢাকা কলেজের শিক্ষকরা এসে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে রাস্তার পাশে কলেজ গেটের সামনে নিয়ে যান। এ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করা হয়। শিক্ষার্থীরা বলেন, শনিবারের মধ্যে তাদের দাবি পূরণ না হলে লাগাতার আন্দোলনে যাবেন তারা।
আন্দোলনরত এসব শিক্ষার্থীরা বলেন, পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্রদের হাফ পাস নিশ্চিত করতে হবে। শনিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হল। শনিবারের মধ্যে এ বিষয়ের একটি সুরাহা চান তারা। তা না হলে পরে কঠোর আন্দোলন করা হবে
হাফ ভাড়া নিয়ে আন্দোলন করা ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী অনিক হোসেন বলেন, বাসে হাফ ভাড়ার প্রচলন অনেক আগে থেকেই। সেই নিয়ম কেন মানবে না মালিকরা। তারাও (বাস মালিকরা) যখন শিক্ষার্থী ছিলো তারাও হাফ ভাড়া দিয়েছে। আমাদের একটাই দাবি পরিহনে ভাড়া হাফ করতে হবে।
এ বিষয়ে এসোসিয়েশন অফ বাস কোম্পানিজের সভাপতি রফিকুল হোসেন কাজল বলেন, সরকার থেকে যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে তাতে বাসে হাফ পাস দিয়ে সেই লসই থেকে যায়।
তিনি বলেন, ঢাকায় পরিবহনে বেশিরভাগ যাত্রী নিজেদের ছাত্র পরিচয় দেয়, একটা বাসে যদি ১০ জন যাত্রীর ৯ জন ছাত্রের হাফ ভাড়া দেয়া হয় তাহলে লাভ থাকে কিভাবে।
জানা যায়, আইনগত ভিত্তি না থাকলেও হাফ ভাড়া শিক্ষার্থীদের অধিকার। পাকিস্তান শাসনামলে আন্দোলন করেই সেই অধিকার আদায় করেছে শিক্ষার্থীরা। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ‘১১ দফা’ নামে শিক্ষার্থীদের যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখা যায়, সেখানে হাফ ভাড়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিল।
এবিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই দেশে হাফ ভাড়ার প্রচলন ছিলো। তখন বাস মালিকরা শিক্ষার্থীদের থেকে হাফ ভাড়া নিতে পরিবহন শ্রমিকদের বলে দিত। এর জন্য তাদের আইডি কার্ডও দেখা হতো না। বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি ও বেসরকারি গণপরিবহনগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় দেয়া হয়।
তিনি বলেন, সরকার থেকে পদক্ষেপ নিয়ে বাস মালিকদের সঙ্গে বসে ছুটির দিন ব্যাতিত শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য একটা প্রজ্ঞাপন দিয়ে আইন করলে বিষয়টি মিমাংসিত হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সিট রেখে হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা উচিত।