অযাচিত মন্তব্যের বেড়াজালে পদ সৃজন, বিব্রত শিক্ষকরা
মো. শরীফ উদ্দিন আহমেদ।।
জনাব ইকরামুল হক ঢাকার একটি স্বনামধন্য কলেজের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষক। তাঁর কলেজটি সরকারীকরণের প্রক্রিয়ায় আসে ২০১৬ সালে।
সবশেষে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে 'সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা - ২০১৮' এর আলোকে একযোগে ২৭১ টি কলেজের সাথে এ কলেজটিও সরকারি হয়। এরপর থেকে সবাই মোটামুটি জেনে গেছেন তিনিও সরকারি হয়েছেন।
সম্প্রতি গত ১৯ আগস্ট মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক এ কলেজের পদ সৃজনের তালিকায় দেখা যায় তাঁর নামের পাশে মন্তব্য কলামে লেখা রয়েছে 'সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রি নেই।'
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তালিকাটি প্রকাশের পর তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীগণের মধ্যে থেকে অনেকেই ফোন করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে তাঁকে। অথচ একই বিধিমালায় এর কিছুদিন আগেই গত ১৪ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নওগাঁর মহাদেবপুরের জাহাঙ্গীরপুর বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের, কলেজ শাখার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের প্রভাষক জনাব আনোয়ার হোসেনের এডহক নিয়োগ হয়েছে তাঁর মূল বিষয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে।
অর্থাৎ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষকদের মূল বিষয়ে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে এর আগেই বিষয়টি মীমাংসিত হয়েছে। তাহলে একটি মীমাংসিত বিষয়ে আবারও কেন এই বিরূপ মন্তব্য? প্রশ্ন ইকরামুল হকের।
এ সমস্যা শুধু এই কলেজের নয়, এ চিত্র সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পদ সৃজনের প্রকাশিত তালিকায় থাকা সবকয়টি কলেজের। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষকদের মন্তব্য কলামে লেখা, 'সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রি নেই। এ বিষয়ে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মতামত প্রয়োজন' ইত্যাদি ইত্যাদি।
মূলত ২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ২০০ নম্বরের ঐচ্ছিক কম্পিউটার শিক্ষার পরিবর্তে ১০০ নম্বরের আবশ্যিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয় সংযোজিত হয়। এটা সরকারের খুবই সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ উদ্যোগের ফলে শিক্ষার্থীরা বাধ্যতামূলকভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে। বিশ্বায়নের এ যুগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির জ্ঞান লাভের কোনো বিকল্প নেই।
বিষয়টি আবশ্যিক হওয়ার পর থেকে কম্পিউটার শিক্ষার শিক্ষকগণ এ বিষয়ের শিক্ষক হিসেবেই নিয়মিত হন। প্রথমদিকে নট্রামস অনুমোদিত ৩ মাস মেয়াদি কম্পিউটার প্রশিক্ষণধারীগণকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান ছিল।
পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ৭ জুন এক পরিপত্র জারির মাধ্যমে সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে ৬ মাস মেয়াদি কম্পিউটার প্রশিক্ষণধারীগণকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বেসরকারি কলেজগুলোতে ৬ মাস মেয়াদি কম্পিউটার কোর্সধারীগণকে নিয়োগের ধারা অব্যাহত ছিল। পরবর্তীতে 'স্কুল ও কলেজ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা - ২০১৮' এ বেসরকারি কলেজে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগের যোগ্যতা হিসেবে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান বা আইসিটি বিষয়ে ৪ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অথবা স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান বা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বা কম্পিউটার বা আইসিটি বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু সরকারিকৃত কলেজগুলোর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির শিক্ষকগণ 'জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা - ২০১৮' জারির আগেই তৎকালীন প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সের সার্টিফিকেট দিয়ে যথানিয়মেই নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন।
শিক্ষকদের নিয়োগ লাভের যোগ্যতার ক্ষেত্রে 'সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা, ২০১৮’ এর ৫(২) ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “প্রয়োজনীয় যোগ্যতা বলিতে, বেসরকারি কলেজের শিক্ষক পদে নিয়োগ লাভের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতাকে বুঝাইবে।”
এ স্পষ্ট নির্দেশনা মোতাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষকদের বেসরকারি আমলের নিয়ম অনুসারে কম্পিউটার কোর্সই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের ডিগ্রি। এ বিষয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। বিধিমালা অনুসারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়েই তাদের নিয়োগ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মূল বিষয়ে যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেভাবেও করা যেতে পারে। তবে অযাচিত মন্তব্যের দ্বারা শিক্ষকদের বিব্রত করা ঠিক নয়।
ঢাকার দোহারের পদ্মা সরকারি কলেজসহ একাধিক কলেজের সহকারী অধ্যাপকগণের মন্তব্য কলামে লেখা রয়েছে, 'সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মতামত প্রয়োজন।' এতে করেও শিক্ষকদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। পাঁচ বছর ধরে ঝুলন্ত অবস্থায় থেকে তিনবার যাচাই-বাছাই শেষে এখন আবার প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া, এ যেন শিক্ষকদের মরার উপর খাড়ার ঘা!
সহকারী অধ্যাপক পদের ক্ষেত্রে বেসরকারি আমলের তথ্য বলতে কলেজের গভর্নিং বডির রেজুলেশন ও মাউশি অধিদপ্তর প্রদত্ত এমপিও সীটে প্রভাষক এর স্থলে সহকারী অধ্যাপক এবং ৯ম গ্রেডের পরিবর্তে ৬ষ্ঠ গ্রেড লেখা হয়। এ কাগজপত্রগুলো জমা দিয়েই পদ সৃজন হয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের সরকারি ইস্পাহানী কলেজের সহকারী অধ্যাপকগণের, কিন্তু একই কাগজপত্র জমা দিয়েও পদ সৃজন হয়নি অন্যান্য কলেজের সহকারী অধ্যাপকগণের পদ।
বেসরকারি আমলে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলনা এবং ‘সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা, ২০১৮’ এর ৫(২) ধারার ব্যাখ্যা অনুসারে বেসরকারি আমলে বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত সবাইকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান থাকলেও সরকারিকৃত কলেজে পঁয়ত্রিশোর্ধ বয়সে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বয়সের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হচ্ছে।
এতে করে শিক্ষকগণ একদিকে যেমন বিভ্রান্তিতে পড়ছেন অন্যদিকে তেমনি সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে মতামত দিয়ে অচিরেই শিক্ষকগণের বিভ্রান্তি দূর করা প্রয়োজন। একই বিষয়ে অন্যান্য কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখার জোর দাবি জানাই।
'সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা, ২০১৮' এর ৯ ধারায় বেতন-ভাতাদি নির্ধারণ নিয়ে বলা হয়েছে, "অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারীগণ সংশ্লিষ্ট কলেজ সরকারিকরণের তারিখ হইতে বিদ্যমান জাতীয় বেতন স্কেলের সংশ্লিষ্ট গ্রেডের প্রারম্ভিক ধাপে বেতন-ভাতাদি প্রাপ্য হইবেন।"
অর্থাৎ আমাদের শিক্ষকগণ যারা যে গ্রেড এ বেতন-ভাতাদি পাচ্ছেন তাদেরকে বিধিমালা অনুসারে সে গ্রেডের প্রারম্ভিক ধাপেই বেতন-ভাতা নির্ধারণ করতে হবে। জাহাঙ্গীরপুর বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের, কলেজ শাখার ৭ম গ্রেডের শিক্ষকগণকে ৯ম গ্রেড এ নিয়োগ দেওয়া হবে এবং বেতন-ভাতা ৭ম গ্রেডের অনুরূপ নির্ধারণ করা হবে বলা হচ্ছে। এটা যদি করা হয় তা হবে খুবই অমানবিক! এখানে আর্থিক বিষয়টি মূখ্য নয়, গ্রেডের বিষয়টিই মূখ্য বলে মনে করি। আত্তীকরণ বিধিমালা অনুসারে ৭ম গ্রেডেই নিয়োগ দেওয়ার জোর দাবি জানাই।
উপজেলা ভিত্তিক সরকারি হওয়া কলেজের সংখ্যা ৩০৫ টি। বর্তমানে এ তালিকায় দিনদিন আরো কলেজ যোগ হচ্ছে। এসব কলেজের কাজে একটি কলেজের সমস্যা যেভাবে মীমাংসিত হয় অন্য সব কলেজের একই ধরনের সমস্যা একইভাবে মীমাংসিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভিন্ন ভিন্নভাবে সমস্যা সমাধান করতে গেলে আগামী দশ বছরেও সরকারীকরণের কাজ শেষ হবে কিনা সন্দেহ।
আদালতেও কোনো একটি বিষয় মীমাংসা করতে গেলে পূর্বের একই ধরনের রায় থাকলে তা নজির হিসেবে প্রয়োগ হয়। আমাদের সরকারিকৃত কলেজের একটি কলেজের সমস্যা যেভাবে মীমাংসিত হয় অন্য সব কলেজের একই সমস্যায় তা নজির হিসেবে প্রয়োগ সময়ের দাবি। নতুন করে মতামত চাওয়া অবান্তর! এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
ইতোপূর্বে সরকারি কলেজ স্বাধীনতা শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে এসব বিষয়সহ ৯ টি সুনির্দিষ্ট দাবিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে ঝুলে থাকা সরকারীকরণের কাজ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। একই কাগজপত্র মাউশি'র আঞ্চলিক কর্মকর্তাগণ প্রথম সরেজমিনে দেখেছেন।
দ্বিতীয়বার মাউশি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই হয়েছে এবং তৃতীয়বার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণ যাচাই-বাছাই করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়য়ে পাঠিয়েছেন। এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এসব অযাচিত মন্তব্যের বেড়াজালে পড়ে শিক্ষকদের আত্তীকরণের কাজ আবারও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু শিক্ষকরাই নন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ। আত্তীকরণের কাজ শেষ না হওয়ার কারণে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের বেতন ও ফি দিতে হচ্ছে বেসরকারি নিয়মে, অপরদিকে শিক্ষক নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কলেজগুলোতে শিক্ষকদের শূন্য পদ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
সরকারি নির্দেশনা অনুসারে আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে। সরকারি এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীদের পদচারণায় আবারও মুখরিত হোক প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন সে প্রত্যাশা রাখছি। কিন্তু কলেজ খুলে গেলে সরকারিকৃত কলেজগুলোর পাঠদান কার্যক্রম ব্যহত হওয়ার বড় ধরনের শংকা রয়েছে। ব
র্তমান সরকার দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি আমূল পরিবর্তন আনতে উপজেলা ভিত্তিক একটি করে হাইস্কুল ও একটি করে কলেজ সরকারীকরণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেজন্য সরকারের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। অচিরেই এর সুফল পেতে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে আত্তীকরণের কাজ সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
লেখক-
সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত)
সরকারি কলেজ স্বাধীনতা শিক্ষক সমিতি
কেন্দ্রীয় কমিটি