অনিয়মের বহু অভিযোগ নিয়ে অবসরে অধ্যক্ষ
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ অনিয়মের পাহাড় মাথায় নিয়ে গত মঙ্গলবার অবসরে গেছেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার থেকে আসা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার। তবে অবসরের পরও অধ্যক্ষ কামরুন নাহার ও শিক্ষক প্রতিনিধি ড. ফারহানা খানমের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
গত ২৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৭ (প্রতিকল্প) মোহাম্মদ রফিকুল আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো হয়। সেখানে অধ্যক্ষ ও শিক্ষক প্রতিনিধির অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করে আগামী এক মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে। এ চিঠির সঙ্গে ৬২ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রও সংযুক্ত করা হয়। এদিকে গত মঙ্গলবার অধ্যক্ষের অবসরের পর কে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেবেন তা নিয়ে শুরু হয় টানাপড়েন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এক নম্বরে থাকা হাসিনা বেগমের এ দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু সাবেক অধ্যক্ষ কামরুন নাহার ও গভর্নিং বডির তিন-চার সদস্য মিলে গভর্নিং বডির বৈঠক ছাড়াই এ দায়িত্ব জ্যেষ্ঠতার তালিকায় দুই নম্বরে থাকা কেকা রায় চৌধুরীকে দিয়েছেন। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে আবারও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
গতকাল বুধবার গভর্নিং বডির পাঁচজন সদস্য, সিনিয়র শিক্ষকরা পৃথকভাবে গভর্নিং বডির সভাপতি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। এমনকি গতকাল প্রতিষ্ঠানের সামনে শতাধিক অভিভাবক বিধি অনুযায়ী অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে অবস্থান নিয়েছিলেন।
প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সদস্য সিদ্দিকী নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা গত মঙ্গলবার থেকেই গভর্নিং বডির সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। কিন্তু তিনি সরকারের একজন সচিব বিধায় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকায় তার সাক্ষাৎ পাইনি। তবে আমরা বেশিরভাগ গভর্নিং বডির সদস্যই জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু সাবেক অধ্যক্ষ ও তার সহযোগী তিনজন সদস্য মিলে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ শিক্ষক কেকা রায় চৌধুরীর কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন বলে আমরাও শুনেছি। কিন্তু এই কেকা রায় আগে একবার মাত্র তিন দিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পেয়ে শতাধিক অবৈধ ভর্তি করিয়েছিলেন। আমরা জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিতে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি। সেখান থেকে কোনো ফল না এলে আমরা আদালতে যাব।’
জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী, যিনি জ্যেষ্ঠ শিক্ষক তিনিই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পাবেন। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে কোনো জটিলতা থাকলে মাউশি অধিদপ্তর বা শিক্ষা বোর্ড তা নির্ধারণ করে দিতে পারেন। তবে এর বাইরেও বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগের মতো প্রেষণে কাউকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিতে পারেন।’
কামরুন নাহারের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, গভর্নিং বডির অনুমোদন ছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। এমনকি কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়নি। অথচ গভর্নিং বডি প্রবিধানমালা ২০০৯ অনুযায়ী, অধ্যক্ষের এককভাবে কোনো শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা নেই।
অভিযোগে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে ‘ভিএনএসসি শিল্পাঙ্গন’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেখানে পাঁচজন প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী এ শিল্পাঙ্গনে ভর্তি হলেও এর আয়-ব্যয়ের যথাযথ হিসাব দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রেও মাউশি বা শিল্পকলার কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। একইভাবে একটি কারাতে ক্লাবও করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের অনেক অর্থই বিনা রসিদে গ্রহণ করা হয়েছে। অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) নুরুন নবীর মাধ্যমে এ টাকা ভাগাভাগি করা হয়েছে। নিজের লোক দিয়ে প্রশ্নপত্র ছাপিয়েও বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ। প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ব্যবহার করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষার জন্য আদায়কৃত সম্মানীরও একটি বড় অংশ নিয়েছেন অধ্যক্ষ।
অন্য অভিযোগগুলোর মধ্যে আছে দেশে বিদ্যুতের সংকটের সময় শিক্ষকদের কক্ষের জন্য ৭০টির মতো এয়ার কন্ডিশন কেনা হয়েছে। আর প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার বিদ্যুৎ বিল দেওয়া হয়েছে। তবে প্রাপ্যতা অনুযায়ী, অধ্যক্ষের বাইরে কেউ এসি ব্যবহার করতে পারেন না। কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই শিক্ষক প্রতিনিধি ফারহানা খানমের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিন ভাড়া দিয়েছেন। এমনকি এ কাজে গভর্নিং বডির অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। প্রকৃতপক্ষে তারা দুজনই নিজের লোক দিয়ে এ ক্যান্টিন চালাচ্ছেন। প্রতি মাসে অধ্যক্ষ বিপুল পরিমাণ আপ্যায়ন বিল তুললেও কাউকে তেমন কোনো আপ্যায়ন করা হয় না। এমনকি এ অধ্যক্ষের সময়ে স্কুল মাঠে গরুর হাটও বসানো হয়েছে। আর অভিভাবকদের গালাগাল ও পিস্তলের ভয় দেখানো অধ্যক্ষের ফোনালাপ সারা দেশেই তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।
ভিকারুননিসার সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলেন, ‘ভিকারুননিসার কোনো অধ্যক্ষ অবসরে গেলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা কারও কারও রুটিন কাজ হয়ে পড়েছে। কারণ এই ভিকারুননিসাকে পুঁজি করেই অনেকে চলে। কিন্তু গত দুই বছর আমার কাছ থেকে কেউ কোনো অনৈতিক সুবিধা পায়নি। ফলে তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, এটাই স্বাভাবিক।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৬/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়