অনলাইনেও শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি বইয়ের চাপ
নিউজ ডেস্ক।।
করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ প্রায় দেড় বছর। ঘরে একপ্রকার বন্দি, মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য যে সব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে পাঠদান করছে, তারা চাপিয়ে দিচ্ছে বাড়তি বই। এর বাইরে টিউশন ফি পরিশোধের জন্য শিক্ষার্থীদের নানামুখি চাপ দিচ্ছে। টিউশন ফি পরিশোধ না করলে ক্লাসে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলেও দেওয়া হবে না পরীক্ষার ফল—অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের শুনতে হচ্ছে এসব কথাও। তবে শিক্ষকরা বলছেন, যা হচ্ছে সবই স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে।
যে সব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে পাঠদান করছে, এদের মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে টানা বেলা দেড়টা, ২টা পর্যন্ত চলছে ক্লাস। কোনো কোনো স্কুল শুরু হয় ৮টা থেকে। মাঝখানে কিছু ২০ থেকে ২৫ মিনিটের বিরতি পায় শিক্ষার্থীরা। এরপর পুরো সময়টাই শিক্ষার্থীদের কম্পিউটারের মনিটরের সামনে অথবা ট্যাবের স্ক্রিনে কিংবা মোবাইল ফোনের ছোট স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে হয়। দীর্ঘ সময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোনো কোনো শিক্ষার্থী চোখের সমস্যাতে ভুগছে, অসুস্থ হয়ে পড়ছে—এমন অভিযোগ করেছেন অনেক অভিভাবক। অথচ এসব অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বোর্ডের অনুমোদিত বইয়ের বাইরেও অননুমোদিত একাধিক বই পড়ানো হয়।
তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠ্যবই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তিনটি। এছাড়া তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই নির্ধারিত আছে ছয়টি করে। ওপরের শ্রেণিতে এ সংখ্যা আরো বেশি। সরকারি স্কুলগুলো এসব বই অনুসরণ করলেও বেসরকারি স্কুলগুলোতে এই করোনাকালেও পড়ানো হচ্ছে কারিকুলামের বাইরে সাত থেকে আটটি অতিরিক্ত বই।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এনসিটিবির তালিকার বাইরে আরো দুই থেকে আটটি বাড়তি বই পড়তে হচ্ছে শিশুদের। এর মধ্যে বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ বই বেশি। এছাড়া ধর্ম, সমাজ, বিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান, অঙ্কন, হাতের লেখা শেখার বই রয়েছে।
এনসিটিবির করা জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত আলাদা কোনো ব্যাকরণ বই থাকার সুযোগ নেই। কেউ এভাবে ব্যাকরণ বই পাঠ্য করলে তা হবে অবৈধ। কিন্তু স্কুলগুলো তা মানছে না। বাড়তি বই বেশি দামে স্কুল কিংবা পছন্দের দোকান থেকে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।
ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর এক অভিভাবক জানান, তার সন্তানকে বাড়তি তিন থেকে চারটি বই পড়তে হচ্ছে। আর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এক অভিভাবক জানান, অর্থ সংকটের কারণে টিউশন ফি দিতে না পারায় অনলাইনে পরীক্ষা নিলেও ফল দিচ্ছে না স্কুল থেকে। অনলাইন ক্লাসে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, টিউশন ফি পরিশোধ না করলে কোনোভাবে পরীক্ষার ফল জানানো হবে না।
অভিভাবকরা বলছেন, করোনাকালেও জানুয়ারিতে প্রতিটি স্কুল থেকে বইয়ের তালিকা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সে তালিকা ধরে বই কিনতে শিক্ষার্থীদের এক রকম বাধ্য করা হয়। আর অনলাইন ক্লাসে এই বইগুলো পড়ানো হয়। শিক্ষকরা পাঠ্যবইয়ের চেয়ে বাড়তি বইয়ের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুলের শুরুতে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বাড়তি বই পাঠ্য করা হয়। এতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হিসেবে কমিশন পায় প্রতিষ্ঠান প্রধান ও গভর্নিং বডি কিছু সদস্য। প্রকাশকের কাছ থেকে বইয়ের তালিকা নিয়ে সেটি স্থানীয় সবগুলো বইয়ের দোকানে পৌঁছে দেওয়া হয়, যাতে প্রকাশনা সংস্থা থেকে বইগুলো তারা আগেই সংগ্রহ করে নেয়, আর শিক্ষার্থীরা সেই বই ক্রয় করে। আমিরুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, কাজটি যতটা না বেআইনি, তার চেয়েও বেশি নিষ্ঠুর। অতিরিক্ত বইয়ের কারণে অতিরিক্ত পড়া ও পরীক্ষা একটি শিশুর জীবন নিরানন্দ করে দিচ্ছে। বাড়তি বই পড়তে বাধ্য করা হলে শিশু তার জন্য নির্ধারিত বোর্ডের বইয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আজিজুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপেও রাখে শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চায়, সে নিয়মিত টিউশন ফি দিচ্ছে কি না। ‘না’ জবাব পেলে শিক্ষকের কাছ থেকে পালটা প্রশ্ন আসে, কেন দেওনি? না দিলে কিন্তু আর ক্লাসে অংশ নিতে পারবে না। এতে মানসিক চাপে পড়ে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বলে মনে করেন এই অভিভাবক।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন বলেন, বয়স অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী কতটুকু পাঠ গ্রহণ করতে পারে তা গবেষণা করেই সরকার বই প্রণয়ন করে। তাই কোন শ্রেণিতে এর বাইরে বই পাঠ্য করার অর্থ শিক্ষার্থীদের বয়সের তুলনায় বাড়তি বই চাপিয়ে দেওয়া। এতে শিক্ষার্থীর ওপর মানসিক চাপ তৈরি হয়, যা কোনোক্রমেই সুফল বয়ে আনে না। অসাধু ব্যবসায়ী ও অসাধু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের যোগসাজোশেই এটি হয়ে থাকে। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর মনিটরিং করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই শিক্ষক।সূত্র ইত্তেফাক