অদম্য রোজিনা: প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক থেকে বিসিএস ক্যাডার
ঢাকাঃ পৈত্রিক সূত্রে গাইবান্ধার অধিবাসী হলেও বাবা-মায়ের চাকরির সুবাদে ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলায় জন্ম রোজিনা আক্তারের। বেড়ে ওঠাও সেখানে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাবা মায়ের কাছ থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে মায়ের উৎসাহে চলে নাচ, গান, অভিনয় এবং আবৃত্তি চর্চা। দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো হয় বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর।
খুব ছোটবেলায় তার বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। রোজিনা আক্তার তখন দাদির কাছে বড় হতে থাকেন। তার জীবনে দাদির প্রভাবও ছিল অনেকখানি। ৭৫ বছর বয়সেও দাদির নিজ হাতে রান্না করা, খুব ভোরে হাঁটতে যাওয়া এসব অভ্যাস তাকে আলোড়িত করত। আত্মনির্ভরশীলতা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা শিখেছেন দাদির কাছেই। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর রোজিনা আক্তারের জীবন এলোমেলো হয়ে যায়।
কিন্তু তবুও তার নিজের উদ্যম আর দাদির উৎসাহে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ২০১০ সালে সাভার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে ভর্তি হোন সাভার সরকারি কলেজে। ২০১২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকের গ-ি পেরোন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। পড়াশোনার যাত্রাটা তার জন্য মোটেই সহজ ছিল না। শৈশবের স্মৃতি তাকে অনেকটা মিইয়ে দেয়।
খুব বেশি বন্ধু-বান্ধব ছিল না কখনোই। নিভৃতচারী রোজিনা আক্তার স্কুল জীবনে কোনোদিনই প্রাইভেট পড়েননি। বরং নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে এক ক্লাস জুনিয়র শিক্ষার্থীদের টিউশন করিয়েছেন। অকপটে স্বীকার করলেন স্কুল কলেজের শিক্ষকদের অবদানের কথা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তার জীবন পাল্টে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থিতু হন রোকেয়া হলে।
পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চলে সাংস্কৃতিক চর্চা। জড়িয়ে যান কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গেও। ভর্তি হন ছায়ানটে। জীবনের সৌন্দর্য নতুনভাবে উপলব্ধি করেন গানের জগতে প্রবেশ করে। এ সময় ক্যাম্পাসের নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাড়তে থাকে তার সবর উপস্থিতি। গান, কবিতা আবৃত্তি, অভিনয় আর উপস্থাপনায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে থাকেন।
সেই সঙ্গে ভালো সিজিপিএ তাকে মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বীকৃতিও ধরে রাখে। তার মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটি তার জীবনের সেরা সময়। এই সময়টাতে তিনি নিজেকে গড়েছেন। বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তির পেয়েছিলেন সান্নিধ্য যারা তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের পাথেয় ছিল।
পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২০২৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেয়েও যান। কিন্তু লক্ষ্য ছিল আরও সামনে এগুবার। তাই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে। ৪০ এবং ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় নন-ক্যাডার আসায় তিনি হতাশ হয়ে যান।
তবুও সকল প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নতুন আত্মপ্রত্যয় নিয়ে ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। অবশেষে সফলও হন। ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। রোজিনা আক্তার অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তদের তালিকায় নিজের রোল নম্বর দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হন।
রোজিনা আক্তারের মতে তার সাফল্য অর্জনের পেছনে তার অধ্যবসায় আর বই পড়ার অভ্যাস সহায়ক ছিল। একাডেমির বাইরেও তিনি নিয়মিত বই পড়েন। সংগ্রামময় জীবন তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এখন তার ইচ্ছে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে যাবেন।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১০/০২/২০২৪